প্রতিনিধি ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ , ৪:৫৪:২৪ প্রিন্ট সংস্করণ
মো: জুয়েল, বোয়ালখালী প্রতিনিধি : ভাষা আন্দোলনের পর দেশের কোনো কোনো স্থানে স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে মানুষ শহীদ মিনার গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে থাকে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর যখন শহীদ মিনার স্থাপনকে ঘিরে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ঠিক তখনি বেসরকারি উদ্যোগে শহীদ মিনার স্থাপনে কিছু সাহসী প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে দেখা যায়। সেই সাহসী পদক্ষেপের সূচনা হয়েছিল চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে। ১৯৬৫ সালে পাক সরকারের কঠোর বাধা উপেক্ষা করে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার কধুরখীল উচ্চবিদ্যালয়ে স্থাপন করা হয়েছিল স্কুল পর্যায়ে তৈরি সর্বপ্রথম শহীদ মিনার।
একুশের বই মেলার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত ‘একুশের স্মারক গ্রন্থ’ এবং তৎকালীন ওই শহীদ মিনার নির্মাণে উদ্যোক্তাদের সাথে কথা বলে এ তথ্যটি নিশ্চিত করা হয়।
শহীদ মিনার নির্মাণকারী দলের অন্যতম সদস্য ও শহীদ মিনার নির্মাণ কারণে ছাত্রত্ব বাতিল হওয়া প্রাক্তন কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র নুরুল হুদা জীবদ্দশায় সাংবাদিকদের বলেন, ১৯৬৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। তখন মধ্যরাত। কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একত্রিত হই আমি, মোহাম্মদ আলী, সৈয়দ জালালউদ্দিন, সৈয়দুল আলম, আবদুল্লাহ আল নোমান সহ কয়েক তরুণ। গাছের গুঁড়ি, ইট, পাথর ইত্যাদি নিয়ে এসেছি আমরা। রাতের আঁধারে কাজ করতে নিয়েছি হারিকেন। কিন্তু তাতে অন্ধকার পুরোপুরি দূর হচ্ছে না। তবু কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লাম মনের জোরে। আমাদের পিছনে শাসকের চোখ রাঙানিও রয়েছে। তবে তা ঠুনকো হয়ে গেছে বাংলা ভাষার আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে। হারিকেনের কাঁপা আলোয় সেই রাতেই গড়ে উঠল অনন্য প্রাণের প্রিয় শহীদ মিনার। পরদিন প্রথম প্রহরে ফুল হাতে সেখানে হাজির হলো আশপাশের স্কুল-কলেজের অসংখ্য শিক্ষার্থী। মাতৃভাষা বাংলা রক্ষায় যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের স্মরণ করা হলো ফুলেল শ্রদ্ধায়। তা দেখে আমাদের সবার চোখে মুখে আনন্দের ঢেউ। স্মৃতির এই মিনার নির্মাণের অপরাধে কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়ের জন্য বিজ্ঞান শিক্ষায় যে বরাদ্দ ছিল, তা বাতিল করে দিল পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার। বহিষ্কার করা হয় হলো আমি সহ আমার সহপাঠী দু’জনকে। তাতেও দুঃখ লাগেনি স্মৃতির মিনারে শ্রদ্ধা সাথে ফুল দিতে আসা জনসাধারণ দেখে।
শহীদ মিনার নির্মাণকাজে যাদের অবদান অবিস্মরণীয় তারা হলেন, শাহজাদা সৈয়দ রেজাউল আকবরী, মরহুম আবুল হোসেন, সৈয়দ নুরুল হুদা, মাহাবুব উল আলম, মরহুম ফরিদ উদ্দিন জালাল, পিযুষ চৌধুরী, মিলন নাথ, যোগব্রত বিশ্বাস, আবদুস সাত্তার, দুলাল মজুমদার, আবুল কালাম আজাদ, মো. ওসমান, এস এম ইউছুফ, তসলিম উদ্দিন, জাকির হোসেন সহ আরো অনেকে। পুরো বিষয়টি তদারকি করেছিলেন কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষক কাজী আব্দুল গণি ছাবেরী।’
একুশের বই মেলার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত ‘একুশের স্মারক গ্রন্থ’-এর ৮৯৭ পৃষ্ঠায় ভাষা আন্দোলন গবেষক এম এ বার্নিকের লেখা ‘জেলায় জেলায় শহীদ মিনার’ অধ্যায়ে উল্লিখিত বর্ণনায় বলা হয়েছে- ‘চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে অবস্থিত কধুরখীল উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শহীদ মিনার নির্মাণের দায়ে আবুল হাসান ও সৈয়দ নুরুল হুদা স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। শহীদ মিনারটি নির্মিত হয় ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫ সালে রাত্রিবেলা। শহীদ মিনার নির্মাণের কারণে স্কুলটির বিজ্ঞান শিক্ষা বরাদ্দ ওই বছর বাতিল করা হয়েছিল।’
শহীদ মিনার নির্মাণের অন্যতম উদ্যোক্তা প্রাক্তন সৈয়দুল আলম বলেন, শহীদ মিনার তৈরি করলে স্কুলের অনুদান বন্ধ হয়ে যাবে এমন আশঙ্কায় স্কুল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকরা এ উদ্যোগে বাধা দেন। তবে তাদের আশঙ্কার পরও শিক্ষার্থীরা তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। রাতে স্থানটি পাহারা দিয়ে রেখে ভোরের দিকে কয়েকজন ছাত্র একত্রিত হয়ে ইট আর সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করেন পিরামিড আকৃতির স্তম্ভ। তখনও দেশের অন্য কোনো স্কুলে শহীদ মিনার তৈরি করা হয়নি। এটি দেখতে ও শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে তাই তখন অনেকেই দূর-দূরান্ত থেকে স্কুলে ছুটে আসেন। আর এদিকে সেই রাতে যাদের উদ্যোগ ও সাহসে শহীদ মিনারটি নির্মিত হয়েছিল তাদের অনেকই এখন বেঁচে নেই। শুধু শহীদ মিনার নির্মাণের অপরাধে আমার, মরহুম নূরুল হুদা ও মরহুম সৈয়দ আবুল হাসানকে স্কুল থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল।’
এ প্রসঙ্গে কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিশ্বজিৎ বড়ুয়া বলেন,বিদ্যালয় পর্যায়ে প্রথম শহীদ মিনার এটি। এই শহীদ মিনারকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতির দাবি জানানো হয়েছে ২০০৯ সালে। এছাড়া বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত একুশের স্মারকগ্রন্থে ৮৯৭ পৃষ্ঠায় দেশের স্কুল পর্যায়ে প্রথম শহীদ মিনার হিসেবে এ বিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য জনক হলেও সত্য ৫৮ বছর পার হলেও স্বীকৃতি মেলেনি এই শহীদ মিনারের।
সরেজমিনে কধুরখীল স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলের লাগোয়া ঐতিহাসিক শহীদ মিনারটিতে তিনিটি ত্রিকোণাকৃতি স্তম্ভ রয়েছে। স্তম্ভগুলো দেখতে অনেকটা পিরামিডের মতো। বেদীর নিচে লেখা রয়েছে- ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’। ছোট্ট এ মিনারটি এ অঞ্চলের মানুষের বাংলা ভাষার প্রতি অগাধ ভালোবাসার অনন্য প্রতীক। জাতীয় দিবসগুলোতে স্থানীয় লোকজন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানায় এ শহীদ মিনারে।
কধুরখীল উচ্চবিদ্যালয় কতৃপক্ষ এ সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দাবি করে আবেদন করেছে বাংলা একাডেমির কাছে। বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ যাচাই-বাছাই করে এটাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেবে এমনটি প্রত্যাশা করে বিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক ও বোয়ালখালীবাসী।