• শিল্প-সাহিত্য

    কোরবানির একাল-সেকাল

      প্রতিনিধি ২৪ জুন ২০২৩ , ৯:৫৫:২৭ প্রিন্ট সংস্করণ

    নুরুল মুহাম্মদ কাদের:

    ‘অন্তরে ভোগী বাইরে যে যোগী মুসলমান সে নয়,
    চোগা চাপকানে ঢাকা পড়িবে না সত্য সে পরিচয়।
    বকরীদি চাঁদ করে ফরিয়াদ, দাও দাও কোরবানি
    আল্লারে পাওয়া যায় না করিয়া তাহার না-ফরমানি’।
    জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার বকরীদ কবিতায় লিখেছেন কোরবানী ভোগের জন্য নয়। ১৯৮৮ সালে আমি ৩য় শ্রেনির ছাত্র থাকাকালীন সময় হতে আমার কোরবানীর কথা মন পড়ে। আমার বাবাসহ সাতজন আত্মীয় বা প্রতিবেশি মিলে সাতভাগে ভাগ করে গৃহপালিত একটি গরু দিয়ে কোরবানি দিতেন। সেসময় গ্রামের কমসংখ্যক লোক কোরবানী দিতেন। বাজারে দুই-একদিন পশুর হাট বসলেও বেশিরভাগ কোরবানী দাতারা কৃষকের কাছ থেকে গরু কিনে কোরবানী দিতেন। অনেকে গৃহপালিত পশু দিয়ে কোরবানী করতেন।




    যেহেতু প্রিয় বস্তু কোরবানী দিতেন সেহেতু অনেকে নিজের পালিত গরুটিকে কোরবানীর পূর্বমুহুর্ত পর্য্যন্ত যত্নআত্তি করতেন। অনেক কোরবানী দাতারা মাসখানেক আগে থেকে গরু কিনে নিজের সন্তানের মতো দেখভালো করতেন। কেউ কেউ গরু ক্রয় করে কৃষকের বাড়িতে রেখে দিয়ে কোরবানীর ঠিক আগের দিন কৃষকের বাড়ী থেকে গরুটি নিয়ে আসতেন। কৃষক গুরুর মাথায় হাত বুলিয়ে সন্তানের মতো আদর করে গরুর রশি কোরবানী দাতার হাতে ধরে দিয়ে ঘাটা অবধি আগিয়ে দিতেন।

    প্রিয় গরুটি চির বিদায় দেয়ার সময় বিক্রিত টাকা হতে কিছু বিশ-পঞ্চাশ টাকা ফেরত দিতেন। অনেকে কান্না করতেন। ১৯৮৯ সালে এ রকম গরু আনতে গিয়ে আমরা গরুর মালিকের কাছ থেকে ৩০ টাকা ফেরত পেয়ে অনেক খুশি হয়েছিলাম। দারিদ্রতার কারনে গ্রামের সিংহভাগ মানুষ কোরবানী দিতে পারতনা। যারা কোরবানী দিতে পারতনা তাদের ঘরে মাংস পাঠিয়ে দেয়া হতো। অন্যদের থেকে প্রাপ্ত গরুর মাংস রান্না হতো প্রত্যেক বাড়িতে। কোরবানীর পূর্বরাত রাত ১২ টার পর নতুন চালের আটার প্রায় শ-দুয়েক ধবধবে সাদা রটি বানানো হতো। গোসল করে নতুন জামা পড়ে ঈদের নামাজের পর সব কাজ শুরু হতো। ঈদের দিন প্রতিবেশি ও অভাবী লোকদেরকে এ রুটি মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো।




    ১৯৯১ সালে প্রবল ঘুর্নিঝড়ের ফলে বছর দুয়েক অর্থভাবে কোরবানী দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে বাড়িতে কোরবানি দিলে আনন্দটা বেড়ে যায়। আমার বাড়ী ছিল স্কুলের পাশাপাশি এবং আমি ছিলাম স্কুলের ক্যাপটেন। স্কুল খোলার দিন ১০-১৫ জনের মতো স্কুল সহকর্মিদের নিয়ে রুটি-মাংস খেতাম একসাথে। মা, রান্না করে খাওয়াতেন। ছাত্রজীবেন যুক্ত ছিলাম সেচ্চাসেবি সংগঠনের সাথে। আয়োজন করতাম ঈদ পুনর্মিলনী। সবকিছু মিলিয়ে ছাত্রজীবনের দুই ঈদে আনন্দ উৎচ্ছ্বাস ছিল ভরপুর।

    কর্মজীবন ও বিয়ের পর সেই কোরবানির আমেজটি হারিয়ে যায়। গরু যবেহ করার পর মাংস ফ্রিজে রেখে সময় মতো খাওয়ার নিয়মে সেকালের ঈদ উৎসব হারিয়ে ফেলেছি। শহরে বহুতল ভবনে বসবাসরত মানুষ জীবনের কোরবানির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য অন্যরকম। পাশের বাসায় কেমন জীবন কাটাচ্ছে সে খোঁজ রাখার উপায় নেই। একালের ঈদ আর সেকালের ঈদের ব্যবধান নিজকে অনেক ভাবায়। ছাত্রত্ব সময়ের বাবার একভাগ কোরবানি ছিল নিকষিত খাঁটি ও বরকতময়। মাঝে মাঝে ভাবি আগুনে পুড়িয়ে কোরবানি কবুল হওয়ার রীতি চালু থাকলে ভোগী লোকগুলি কি কোরবানি দিতো।




    ধর্মগ্রন্থ হতে জানা যায় আগেকার যুগের কোরবানি আল্লাহ্‌র কাছে গ্রহণের বিষয়টি সহজেই বোঝা যেত। শস্য কিংবা প্রাণিই হোক, তখন কোরবানিকৃত বস্তুটি খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল, যেটা এখন নেই। উৎসর্গের জন্য বস্তু কোরবানির বেদীতে রেখে কোরবানদাতা দূরে সরে আসতেন। আকাশ থেকে তখন আগুন এসে পুড়িয়ে দিয়ে যেত সেই উৎসর্গ । পুড়ে গেলে বোঝা যেত, আল্লাহ কবুল করেছেন কোরবানি। যদি আগুন না আসে, তাহলে কবুল হয়নি।

    ইসলামে কোরবানি প্রথা চালু হয় নিজের প্রিয় জিনিসটা উৎসর্গের ধারণা দিয়ে। তাই ইব্রাহিম (আঃ) যখন প্রিয় ইসমাইলকে (আঃ) উৎসর্গের সিদ্ধান্ত নেন তখনই আল্লাহ তাঁর মনের অবস্থা বুঝে তা কবুল করেন। তারপর ইসমাইল (আ:) বদলে পশু জবাই হয় । নিশ্চয়ই এটা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা এবং আমি এক মহান কোরবানির বিনিময়ে সে শিশুকে (ইছমাইল আ:) মুক্ত করলাম” (সূরা আস্ সাফফাত ১০৬ ও ১০৭)। তাই কোরবানি নিছক পশু যবেহ নয়, এতে আরো উচ্চতর তাৎপর্য রয়েছে।




    পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত ‘‘কোরবানির রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, এর গোশ্তও না, বরং তাঁর কাছে পৌঁছায় কেবল তোমাদের তাকওয়া’’ (২২:৩৭)। আজকাল কে কত বড় পশু কিনল আর কত টাকা দিয়ে কিনল । বাজেট আর ওজনের কোরবানি ইসলামের বিধি বিধানের চাইতে লৌকিকতাই বন্দী হয়ে যায়। ক্রয়কৃত পশুর গোস্তের ওজন আগে থেকে অনুমান করা হয়।




    ঈদ আসে ঈদ যায়। ঈদের আমেজ থেকে যায় কিছুদিন। পরিবার থেকে সমাজ হয়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায়। এক ধরনের সংস্কৃতির প্রভাবও পড়ে যা অনেকটা ইতিবাচক বলেই মনে হয়। পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার মাঝে ঈদের মাধ্যমে শুভেচ্ছা বিনিময় হয় আমাদের দেশে। এসব ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় আমাদের খানিকটা আনন্দের উপলক্ষ হলেও প্রকৃত নেতিবাচক মনোবৃত্তি সেখানে ত্যাগের মহিমা ধারণ করে না। মানুষের সুখ-দু:খ, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-প্রীতি, স্নেহ-ভালোবাসা, দয়া-মায়া ইত্যাদি অনুভূতি মানুষের মনে প্রকাশ পায় বলে মনের মানুষই মানুষ। মনের বিকাশ সাধনের মাধ্যমে মানুষ মহৎ হয়। ঈদের প্রকৃত শিক্ষা তথা মনের বিকাশ সাধন ও তার অন্তর্গত ভাব ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে । ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে।




    নুরুল মুহাম্মদ কাদের
    প্রাবন্ধিক ও সংগঠক

    আরও খবর 32

    Sponsered content