প্রতিনিধি ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ , ১১:২১:০৩ প্রিন্ট সংস্করণ
চট্টবাণী : মহানবী হযরত মোহাম্মদ (দ.) ছিলেন ‘আল আমিন’ বা বিশ্বাসী। বিশ্বাসী সত্যবাদী নবী (দ.) উম্মাত হয়ে মিথ্যাটাকে গ্রহণ করছি, মিথ্যা কথা বলছি,সর্বত্র বিশ্বাস ভঙ্গ করে চলছি।, চিটিং বাটপারি অভ্যাসে পরিণত হয়েছে আমাদের। রাজনীতির নামে ধর্মের নামে, সামাজিকতার নামে, মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করি। মুখে দাবি করি আমরা সত্যবাদী নবীর উম্মাত। সৎ মানুষের সংখ্যা এত দ্রুত কমলো কী করে তা ভাবতে পারছি না। আমার বাবা যখন সরকারী অফিসার ছিল তখন তাঁর অফিসের ৩০ জন কর্মচারী-কর্মকর্তার মধ্যে মাত্র ১/২ জন অসৎ ছিল।
তখন নিউজ ছিল এই ব্যক্তি (১/২ জন) অসৎ। বর্তমান কোন সরকারী অফিসে ১০০ জন কর্মকর্তা কর্মচারী থাকলে তার মধ্যে ১/২ জন সৎ লোক পাওয়া কষ্টকর। বর্তমান এই ব্যক্তি সৎ, এটিই নিউজ। সাংবাদিকরা বলছেন, কুকুর কামড় দিলে নিউজ নয়, মানুষ কুকুরকে কামড় দিলে এটিই নিউজ হয়। বর্তমান দেখছি মানুষ রূপী কুকুরগুলো পশুর চেয়ে অধমে পরিণত হচ্ছে। আসলে এই পচা সমাজে কাকে দোষ দিবো। লেখে বা কী হবে। শুধু নৈতিক দায়িত্ব পালন করা ছাড়া আর কিছু না। আড়াই হাজার বছর পূর্বে দার্শনিক প্লেটোর নিকট জানতে চাইলো: ‘সর্বোচ্চ দেশপ্রেম কী? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘প্রতিটি মানুষ নিজের নৈতিক দায়িত্বটা সুচারুরূপে পালন করাই সর্বোচ্চ দেশপ্রেম।’ বর্তমান শিক্ষিত মানুষরা দাবি করে তারা দেশপ্রেমিক। কিন্তু তারা নৈতিক দায়িত্ব পালন করে না। আমার লেখায় সমাজ পরিবর্তন হোক বা না হোক আমি সামান্য দায়িত্বটা পালন করতে চাই। তাই লেখি।
এখন সমাজে প্রচুর মানুষ বলে আমার ভালো কাজে, সততায় কী হবে, সমাজের প্রায়ই মানুষ তো অসৎ, দুর্নীতিগ্রস্ত। প্রকৃত মানুষ হলে এ ধরনের চিন্তা করা রীতিমত আমি পাপ মনে করি। এই বিষয়ে আমি সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বের একটি ঘটনা বলতে চাই। হযরত ইব্রাহিম (আ.) কে যখন অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়, তখন অগ্নি প্রজ্বলিত করতে গিরগিটি নামক প্রাণী আগুনে ফুঁ দেয়। আর আগুন নির্বাপিত করতে ব্যাঙ আগুনে পেস্রাব করে দেয়। গিরগিটির ফুঁ আর ব্যাঙের পেস্রাবে অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলন আর নির্বাপন কোনটি হওয়ার নয়। অগ্নিকুণ্ড হতে মুক্তি পেয়ে হযরত ইব্রাহিম (আ.) ব্যাঙের নিকট একটি প্রশ্ন করেন, ‘তুমি কেন পেস্রাব করতে গেলে, তোমার পেস্রাবে কী অগ্নিকুণ্ড নির্বাপিত হবে’? ছোট প্রাণী ব্যাঙ সাড়ে তিন হাজার পূর্বে যে উত্তরটি দিয়েছিলো, সেটি আধুনিক বিজ্ঞান প্রযুক্তির যুগে এখনো আমাদের জন্য আদর্শ কথা। ব্যাঙ বলছিল, ‘আগুন নির্বাপিত হোক আর নাই হোক,সেটি আমার বিষয় নয়, আমি আমার সামর্থ্য অনুযায়ী নৈতিক দায়িত্ব পালন করেছি।’ সমাজের অধিক মানুষ নষ্ট হয়ে গেছে, দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, অসৎ হয়ে গেছে, আমার ভালো কাজে সমাজ পরিবর্তন হবে না,ভালো কাজ করে কোন লাভ হবে না, এমন কথা বলার সুযোগ আমাদের নেই। প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজ দায়িত্বের জবাবদিহি আল্লাহর নিকট করতে হবে।
প্রকৃত শিক্ষা কী তা আমরা আত্মস্থ করতে পারছি না।শরৎচন্দ্র বলেছিলেন,’শিক্ষা মানে লেখা পড়া জানা নয়, জ্ঞানের প্রসার হৃদয়ের কালচার।’বর্তমান আমরা লেখা পড়া জানি,আচার আচরণ আর শুদ্ধতা জানি না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,’মনুষ্যত্বের শিক্ষাটাই চরম শিক্ষা আর সমস্তই তার অধীন।’ আজ শিক্ষিত মেধাবী মানুষের অভাব নেই, প্রকৃত ভালো মানুষের অনেক অভাব।যে
শিক্ষা দেশপ্রেম জাগ্রত করতে সক্ষম নয়, এই শিক্ষার প্রসারে দেশের কোন উপকার হবে না। আজ মেধাবী হওয়ার চেয়ে দেশপ্রেমিক হওয়া বেশী প্রয়োজন। যে দেশে দেশপ্রেমিকের চেয়ে জ্ঞানী বেশী জন্মাবে সে দেশে কোনদিন শান্তি আসবে না।
বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। ত্রিশ বছর আগে যা চিন্তা করেছি- তার চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর দুনিয়ার সেরা সেরা অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ কোনদিন এগিয়ে যাবে না, দাঁড়াতে পারবে না, এই দেশ দাঁড়ালে যেকোন দেশ দাঁড়াতে পারবে, বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় পাকিস্তানের ক্ষতি হবে না, লাভই হবে। এই ধরনের মন্তব্য করার পিছনে কারণ হিসেবে বলেছেন,’একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সোনার বাংলা শ্মশান বাংলায় পরিণত হয়,পাকিস্তানীরা বাংলাদেশের পাওনা সম্পদ ফেরত দেয়নি,বাংলাদেশে এক ফোঁটা তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ নেই,ভূমির পরিমাণ অনুযায়ী জনসংখ্যায় ঘনবসতিপূর্ণ দেশ,এক রাতের জলোচ্ছ্বাসে এক লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়,ভাটির দেশ হিসেবে বর্ষায় বন্যার পানিতে মরে আর আর শীতের সময় খড়ায় মরার দেশ কোনদিন দাঁড়াতে পারেন না।বাংলাদেশ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় লেখা হতো ‘নো নিউজ ইজ গুড নিউজ’।বাংলাদেশ সম্পর্কে কোন নিউজ না থাকা মানে ভালো সংবাদ।কারণ কোনো সংবাদ থাকা মানে নেতিবাচক সংবাদ।তখন বাংলাদেশের সংবাদ মানে খরা, মঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, জলোচ্ছ্বাস, সংঘাত, হরতাল,অবরোধ,হত্যা ইত্যাদি। এই দেশটি আজ মানব উন্নয়নের সূচক, রিজার্ভ, বৈদিক মুদ্রা আয়ে পাকিস্তানকে পিছনে ফেলে, কিছু ক্ষেত্রে ভারত হতে এগিয়ে যায়। অর্থনৈতিক, শিক্ষার হার, জীবনযাত্রার মান সবই উন্নতি হয়েছে। কিন্তু কমছে সততা, ভদ্রতা। আমি আমার একটি লেখায় শিরোনাম দিছি,’বাড়ছে জনসংখ্যা, কমছে মানুষ।’ সরকারের খাতায় জনসংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু প্রকৃত মানুষের সংখ্যা কমছে। আরেকটি লেখার শিরোনাম দিছি, ‘বাড়ছে পরীক্ষার্থী, কমছে শিক্ষার্থী। পরীক্ষায় পাশ করে অর্থবিত্তের মালিক হবে এই লক্ষ্যে পড়ছে।জীবনবোধের শিক্ষা, যে শিক্ষা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করবে, দেশ সমাজের কল্যাণ করার সে শিক্ষার অভাব বাড়ছে। যার কারণে আইন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বাড়ছে কিন্তু কমছে না অপরাধ। সকালে পত্রিকার পাতায় দৃষ্টি দিলেই দেখি খুন, হত্যা, শিশু হত্যা, শিশু নির্যাতন, পারিবারিক হত্যাসহ সবই মন খারাপ করার সংবাদ। যে দেশে জীবন যাত্রার মান বাড়ছে, সে দেশের পত্রিকার পাতা খুললেই সকালে মন খারাপ হয়, সে দেশের মানুষ সারাদিন ভালো কাটাবে কী করে?
মাদার তেরেসা বলেছেন,’হাম,ডায়েরীয়া, এইডস,ক্যান্সার বড় রোগ নয়,বড় রোগ হলো মানুষকে মানুষ ভালো না বাসা।’ মানুষ যদি মানুষকে ভালোবাসতে পারতো,তাহলে সকল রোগ ব্যাধি দূর করা কঠিন হতো না।প্রকৃতপক্ষে মানুষ মানুষকে ভালোবাসলে ১ ভাগ চিকিৎসা সেবায় আর ১০ ভাগ মারণাস্ত্রের জন্য মানুষ ব্যয় করতো না।মানুষ হাম কলেরা বিজয় করেছে,কোভিট বিজয় করেছে,একদিন বড় বড় রোগ দুনিয়া হতে বিদায় করবে,কিন্তু আধুনিক বিশ্বে দিন দিন বাড়ছে যে মানসিক অসুস্থতা তার চিকিৎসা ব্যবস্থার কোনো উন্নতি নেই।স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, মানুষের ৭০ ভাগ রোগ মানসিক আর ৩০ ভাগ রোগ আঘাতজনিত এবং জীবাণুবাহি।৩০ ভাগ রোগের চিকিৎসার জন্য শত শত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হলেও মানসিক রোগের চিকিৎসা তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। মানসিক রোগের সাথে অর্থনৈতিক কোন সম্পর্ক নেই। কোভিট কালে শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হলেও দুনিয়ার মধ্যে দেশটি মানসিক সুস্থতায় শীর্ষে রয়েছে। এতে আত্মস্থ হয় যে মানসিক সুস্থতার জন্য আর্থিক উন্নতির কোন সম্পর্ক নেই।
লেখক: কলামিস্ট ও রাজনীতিক।