• শিল্প-সাহিত্য

    শাসন নয়, অনুশাসনেই মুক্তি: ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

      প্রতিনিধি ২৫ জানুয়ারি ২০২৫ , ১১:০৫:৪৩ প্রিন্ট সংস্করণ

    0Shares

    চট্টবাণী: মানুষের অনেক ধরনের অসুস্থতা রয়েছে। তার মধ্যে বড় অসুস্থতা হলো মানসিক অসুস্থতা। সমাজে বহু মানুষ দেখতে পাই, যাদের নিকট আপনি কোন কারণ ছাড়াই শত্রু। কোন কারণ ছাড়াই তারা আপনার সমালোচনা করছে।

    বুদ্ধিমানরা সমালোচনা সহ্য করেন, কারণ তাঁরা জানেন বদনামে ৫০ ভাগ নাম। বাংলাতে একটি কথা আছে,’যা অযোগ্য তা অমনোযোগ্য’। সমালোচিত হওয়ারও যোগ্যতা লাগে।যোগ্যরাই সমালোচনার মনোযোগ আকর্ষন করতে পারে বলে সমালোচিত হয়। মনোযোগ আকর্ষণের যোগ্যতা সবার থাকে না। সমাজে এমন কিছু লোক আছে তারা শুধু সমালোচনা করে না,রীতিমত মানুষের ক্ষতি করতে চেষ্টায় থাকে। তাদের শত উপকার করেও আপনি প্রিয় হতে পারবেন না। এটা তাদের দোষ নয়, তাদের রক্তের দোষ, মানসিক অসুস্থতা।এই অসুস্থতার চিকিৎসা করা কঠিন। পৃথিবী বেশীর ভাগ মানুষ শারিরীক পাপের চেয়ে মানসিক পাপে বেশী লিপ্ত। এই মানসিক পাপই সমাজের বড় ক্ষতি করে। অহংকার,হিংসা, ঈর্ষা, লোভ, মোহ, ঈমানহীনতা সবই মানসিক পাপ। সমস্ত শারিরীক পাপের উৎস মানুষের অন্তর। শারীরিক পাপের ব্যাপক আলোচনা হলেও আত্মিক ও মানসিক পাপের আলোচনা তেমন হয় না। ব্যভিচার, চুরি, ডাকাতি, হত্যা, মধ্যপানের শারীরিক পাপ।শারীরিক পাপ নিয়ন্ত্রণে আইন করা যায়, বিচার করা যায় কিন্তু মানসিক পাপের আইন ও বিচার নেই। আত্মিক পাপ আত্মাকে নষ্ট করে। নষ্ট আত্মা দ্বারা পুণ্য কাজ করা সম্ভব নয়। শারীরিক পাপকে সমাজ বড় করে দেখে। মানসিক পাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে শারীরিক পাপ কমে যায়। মানসিক পাপের কারণে মানুষ আজ লজ্জাহীন হয়ে পড়েছে। সমাজের ঋণখেলাফি, ব্যাংক লুঠেরা ঋণের কারণে আত্মহত্যা করে না। কারণ তাদের লজ্জা নেই। তারা লুঠ করে সমাজে দাপটের সাথে চলাফেরা করে। অথচ সামান্য ঋণের বোঝা বহন করতে না পেরে অনেক মানুষ আত্মহত্যা করে। কারণ তাদের আত্মমর্যাদা এবং লজ্জা আছে।

    সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার উপায় দুটি,শাসন আর অনুশাসন। অনুশাসন বা উপদেশ দ্বারা বড় ধরনের পরিবর্তন করা যায়। অনুশাসনের মাধ্যমে মানুষের বিশ্বাস ও চিন্তাধারার পরিবর্তন করা যায়। ফলে সমাজ পরিবর্তণ সহজতর হয়। আইন দ্বারা শাসন করা গেলেও সমাজের ব্যাপক জনগোষ্ঠির পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। আইনের দ্বারা জোর করে কোন কিছু চাপিয়ে দেওয়া মানে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের মত। যার সাইড এফেক্ট থাকে। আবার শারীরিক শাস্তির চেয়ে মানসিক শাস্তি অনেক কষ্টের। অল্প সময়ের গুনাহের শাস্তি দীর্ঘস্থায়ী মানসিক যন্ত্রণা ও অস্থিরতায় অশান্তি সৃষ্টি করে। মানসিক শান্তির জন্য পাপমুক্ত থাকার বিকল্প নেই। মনে রাখা দরকার, ক্ষমতার দৌড় মৃত্যু পর্যন্ত, পরিবারের মায়া কবর পর্যন্ত, আর নেক আমল জান্নাত পর্যন্ত। সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকা কঠিন কিন্তু জান্নাতে যাওয়ার পথ মসৃণ হয়। যে পথে কাঁটা নেই,সেটি পথ নয়, সেটা কার্পেট। কার্পেটে হেঁটে মজলিশে পৌঁছা যায়, মনজিলে নয়, মনজিলে পৌঁছাতে সাধনা লাগে। সাধনা কঠিন। সহজ কাজে ‘সাধনা’ শব্দ ব্যবহার করা হয় না। সবচেয়ে বড় সাধনা হলো বন্দেগী ও গোলামী। মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে গোলামীর জন্য। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন ‘ওয়ামা খালাকতুল জিন্না ওয়াল ইনসা ইল্লা লিয়াবুদুন’ অর্থ: আমি জ্বীন ও ইনসানকে আমার গোলামির জন্য সৃষ্টি করেছি। গোলামের কোন অহংকার থাকতে পারে না। অহংকারের এক মাত্র মালিক আল্লাহ। আল্লাহ পাক বলেছেন, অহংকার আমার চাদর। যে বান্দা অহংকার করলো সে আমার চাদর ধরে টান দিল। ইসলাম ধর্মে অহংকারের কোন সুযোগ নেই।

    দুনিয়ার সেরা ধনকুবের যদি আস্তিক হন, মুসলমান হন, তার বিশ্বাস থাকবে এ সমস্ত সম্পদের মালিক আমি নই,মহান আল্লাহ পাক। এই বিশ্বাসী মানুষের মনে সম্পদের অহংকার আসার সুযোগ নেই। আর ধনী ব্যক্তি যদি নাস্তিক হয়, সে বিশ্বাস করবে,তার অর্জিত সব সম্পদের মালিক সে নিজেই। এই ধারণা মানুষের মনে অহংকারের জন্ম দেয়।
    মহান আল্লাহ পাক ধনীর ওপর যাকাত ফরজ করেছেন। যাকাত করুণা নয়, ধনীর উপর গরিবের ঋণ। ধনী ব্যক্তি গরিবের এই ঋণ আদায় করতে না পারলে সমস্ত সম্পদ অপবিত্র হয়ে যায়। যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র হয় বলে ‘যাকাত’ শব্দের আভিধানিক অর্থ পবিত্র করা। দুনিয়ার সেরা ধনী যদি আস্তিক, মুসলমান হন, সে চিন্তা করবে আমি রাস্তার হাত পা নেই এই ধরনের অসহায় দুস্থ মানুষের নিকট ঋণগ্রস্ত। এমন ধনী মানুষের অহংকার করার মানসিকতা থাকে না। আর ধনাঢ্য ব্যক্তি যদি নাস্তিক হয়, সে ভাববে আমার নিকট বহু মানুষ ঋণী, আমি কারো নিকট ঋণী নই। এই চিন্তা মানুষকে অহংকারী করে তুলে। অহংকার মানুষকে অমর্যাদা-অপমান করার শিক্ষা দেয়। ইসলাম মানুষকে সম্মান করার শিক্ষা দেন, মর্যাদা দেন।

    মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘খালাকাল ইনসানা মিন নুতফাতিন’ মানুষকে নাফাক শুক্র কীট হতে সৃষ্টি করেছি। নাফাক বস্তুতে যে মানুষের অস্তিত্ব, সে মানুষ অহংকারী হবে কী করে!

    মানুষ এমন একটা প্রাণী যে বাথরুমে মলমূল ত্যাগের সময় প্রতিদিন সুইপারের কাজ করতে হয়। সে মানুষের অহংকার থাকে কী ভাবে। অহংকারের কারণে ফেরাউন, সাদ্দাদের মত প্রভাবশালী ব্যক্তি ধ্বংস হয়ে গেছে। শয়তান হয়েছে চির অভিশপ্ত। শ্রেষ্ঠত্ব ইবাদাত এবং জ্ঞানে নয়, প্রেমে। প্রেমহীন ইবাদত ও জ্ঞান পথভ্রষ্ট করে। তার প্রমাণ শয়তান। শয়তানের নিকট সব জ্ঞান ছিল কিন্তু সীনার জ্ঞান দিল না, তাই আদম (আঃ)’র নিকট বিনয়ী হতে পারেনি। যুক্তি আর বুদ্ধির নাম ধর্ম নয়, প্রেমের নাম ধর্ম। প্রেম আদম (আঃ) হতে আর যুক্তির শুরু শয়তান হতে।

    হযরত ইমাম গাযযালী (রা:) ছিলেন ইসলামের বিশাল সম্পদ। মানীষীরা বলেন, দুনিয়া হতে সমস্ত কিতাব যদি হারিয়ে যায়, আর ইমাম গাযযালী (রহঃ)’র লিখিত গ্রন্থ ‘এহইয়াউ উলুমিদ্দীন’ যদি পাওয়া যায়, এই গ্রন্থের কারণে ইসলাম আবার পুনর্জীবিত হবে। এই ইমাম গাযযালী (রঃ) জীবনের অধিকাংশ সময় কাটান দার্শনিক যুক্তি তর্ক দ্বারা ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে। ইসলাম বিরোধীদের সাথে যুক্তি তর্ক করে বীরত্বের সাথে জয়ী হতেন বলে তাঁকে ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ (ইসলামের যুক্তি প্রমাণ) বলা হতো। কিন্তু শেষ জীবনে এসে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বদলান। তিনি বলেন ‘তর্কবিতর্কের চেয়ে আখেরাতের জন্য আমলই শ্রেষ্ঠ। আমি যদি আমার জীবনটা যুক্তি তর্কে না কাটিয়ে আমলে উৎসর্গ করতাম তাহলে আখিরাতে আমার সম্মান আরো উচ্চাসনে যেতো।’ তিনি তার ‘রিসালা’ নামক চিঠিতে লেখেছেন, তর্ক করলে জ্ঞান কিছুটা বাড়ে, সত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। কিন্তু ক্ষতির পরিমাণও অনেক। যুক্তি তর্কে লোক দেখানোর মনোভাব (রিয়া) থাকতে পারে। বিজয়ের কারণে অহংকার জন্মতে পারে। বিজয়ী পক্ষ অহংকারী আর পরাজিতরা অপমানিত হয়। আমল বিনয়ী করে। পরিশুদ্ধ করে। মনষীরা বলেন,ঐ যুদ্ধই প্রকৃত যুদ্ধ, যে যুদ্ধে কেউ পরাজিত হয় না। হৃদয়ের পরিশুদ্ধতার জিহাদে কেউ পরাজিত হয় না।সকলেই বিজয়ী হন।
    লেখক: কলাম লেখক, রাজনীতিক।

    0Shares

    আরও খবর 32

    Sponsered content