প্রতিনিধি ১২ আগস্ট ২০২৩ , ১১:১১:৩৮ প্রিন্ট সংস্করণ
বিশেষ প্রতিনিধি: কক্সবাজার জেলার চকরিয়ায় এক সপ্তাহের অধিক সময় ধরে টানা ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার পানি কমলেও বেড়েছে জনদূর্ভোগ । বন্যার পানি কমার সাথে সাথে উপজেলার ১৮ ইউনিয়ন ও পৌরসভার বিভিন্ন গ্রামীণ এলাকায় ভেসে উঠেছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র। এতে বানভাসি মানুষের বাড়ছে নানান দুর্ভোগ। এবারের ভয়াবহ বন্যা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে এমন ধারণা করেছেন স্থানীয়রা। যার ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিরুপণ করা যায়নি।
চকরিয়া উপজেলার হারবাং, বরইতলী, কৈয়ারবিল, লক্ষ্যারচর, কাকারা, সুরাজপুর-মানিকপুর, বমুবিলছড়ি, ফাঁসিয়াখালী, চিরিংগা, সাহারবিল, পূর্ব বড় ভেওলা, বি.এম.চর, কোনাখালী, পশ্চিম বড় ভেওলা, বদরখালী, ডুলাহাজারা, খুটাখালী ও পৌরসভার বাণিজ্যিক এলাকাসহ প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা পানিতে নিমজ্জিত ছিল ৩ দিন।
এ সময় বিভিন্ন ইউনিয়নে অন্তত ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। বন্যাকবলিত অধিকাংশ মানুষের চুলায় আগুন জ্বলেনি। খেয়ে না খেয়ে অন্তত ৩ দিন অতিবাহিত করেছে। বর্তমানে পানি কমলেও সিংহভাগ বাড়িতে ৫-৬ ইঞ্চি পরিমাণ পলিমাটি পড়ায় চলাফেরা ও ঠিকমত রাত যাপন করতেও কষ্ট হচ্ছে। এছাড়া বেশিরভাগ ইউনিয়নের আউশ, আমন, সবজি, মৎস্য, চিংড়ি বানের পানির সাথে ভেসেই গেছে।
চকরিয়ার কৃষি বিভাগের সূত্র মতে, এবারের মহাপ্লাবনে ১১ হাজার ৬০ হেক্টর আউশ, ৫৮৫ হেক্টর আমন বীজতলা ও রোপিত আমন ৭ হাজার ৮০০ হেক্টর সহ সবজি ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। এছাড়া মৎস্য ও চিংড়ি খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। একই সাথে গ্রামীণ রাস্তা-ঘাট, বেশিরভাগই ভেঙ্গে চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
প্রশাসন ও নিজস্ব উদ্যোগে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বেশিরভাগ লোকজন বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করায় প্রাণে রক্ষা পেয়েছে বলে জনপ্রতিনিধিদের অভিমত। তবে চকরিয়ার বেশিরভাগ মানুষ বেকায়দায় পড়েছে গবাদি পশু নিয়ে। বর্তমানে সব ইউনিয়নে গবাদি পশুর খাদ্য সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। অপরদিকে, চকরিয়া উপজেলার জন্য সরকারিভাবে এখনও পর্যন্ত ৪৫ টন চাউল ও ৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। ৪৫ টন চাউলের মধ্যে ২৫ টন চাউল খিচুড়ি হিসেবে রান্না করে বিতরণের নির্দেশনা থাকলেও কারও কপালে জুটেছে, আবার কারও কপালে জুটেনি। যেখানে যাতায়াত ব্যবস্থা খারাপ ছিল, সেখানকার লোকজন রান্না করা খিচুড়ি পায়নি।
অনেকে দাবি করেছেন, বন্যায় ৩ দিন ধরে ক্ষুধায় কষ্ট পেলেও খিচুড়ি বা শুকনো খাবার মিলেনি তাদের কপালে । এবারের বন্যায় সব চাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বরইতলী ইউনিয়নের পহরচাঁদা ও ডেইঙ্গাকাটা, কাকারা, সুরাজপুর-মানিকপুর, বমুবিলছড়ি, ফাঁসিয়াখালীর হাজিয়ান, লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল, বি.এম.চর, পূর্ব বড় ভেওলা, সাহারবিল, পশ্চিম বড় ভেওলা, ঢেমুশিয়া ও বদরখালী।
বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছালেকুজ্জামান জানান, এবারের বন্যায় বরইতলী ইউনিয়নের পহরচাঁদাসহ বেশকিছু এলাকা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া নষ্ট হয়েছে গ্রামীণ অবকাঠামো। যা যথাসময়ে সচল ও পহরচাঁদায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা না হলে ভবিষ্যতে বন্যা হলে আরও মারাত্মক ক্ষতি হবে।
বমুবিলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনজুরুল কাদের জানিয়েছেন, অতীতে অনেক বন্যা হয়েছে, এবারের বন্যার মত এ ইউনিয়নে কোন সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বন্যার পানির তোড়ে মাটির গুদাম বিলীন হয়ে গেছে।
সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম দাবি করেছেন, সুরাজপুর ও মানিকপুরের পুরো এলাকায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত।
হারবাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেহেরাজ উদ্দিন মিরাজ জানিয়েছেন, রেললাইনের কারণে তার ইউনিয়নে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এলাকার লোকজন। তিনি রেললাইনের ব্রিজ, কালভার্ট অপর্যাপ্ত বলে দাবি করেছেন।
এদিকে উপকূলীয় এলাকার ৭টি ইউনিয়ন মারাত্মকভাবে ক্ষতি হওয়ার কারণ জানাতে গিয়ে পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাবলা দাবি করেছেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের টেকসই বেড়িবাঁধের অভাবে বি.এম.চর ইউনিয়নের কন্যারকুম ও কুরিল্যার টেক, পুরুত্যাখালী এলাকার পাউবো’র বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় বি.এম.চর, পূর্ব বড় ভেওলা, কোনাখালী, ঢেমুশিয়া, পশ্চিম বড় ভেওলা ও বদরখালী ইউনিয়নের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তিনি দাবি করেন, এখনও ওইসব এলাকার নিম্নাঞ্চলে হাঁটু সমান পানি রয়েছে। ভাঙ্গা বাঁধ সংস্কার করা না হলে আমন চাষ হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব ফজলুল করিম সাঈদী ইউনিয়ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে ঘর-বাড়িসহ রাস্তাঘাট। বানভাসি মানুষ খুব কষ্টে আছেন। সরকারিভাবে ও বেসরকারি উদ্যোগে যে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে, তা খুবই অপ্রতুল।
তিনি বলেন, উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত বরাদ্দ চেয়ে চাহিদা পত্র পাঠানো হয়েছে। টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় চকরিয়া ১৮টি ইউনিয়ন ছাড়াও পৌরসভা এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যার পানি কমলেও এখন ক্ষতির চিহ্ন দৃশ্যমান হচ্ছে।
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড চকরিয়া উপজেলার শাখা কর্মকর্তা (এসও) মো. জামাল মোর্শেদ বলেন, বন্যার তান্ডবে মাতামুহুরী নদীর চকরিয়া উপজেলা অংশের ৩ স্থানে প্রায় ২৫০ মিটার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে। ভাঙ্গন স্থান দিয়ে নদীর পানি লোকালয়ে ঢুকছে। যতো দ্রুত সম্ভব ভাঙ্গনকৃত বেড়িবাঁধ এলাকা মেরামত করা হবে বলে জানান তিনি।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান বলেন, বন্যাকবলিত প্রত্যেক এলাকা নজরদারি করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার যাতায়াত স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে। দুর্গতদের খাদ্য সহায়তা দিতে উপজেলা প্রশাসন কাজ করছে।