প্রতিনিধি ১৬ এপ্রিল ২০২৩ , ৯:২১:৩৪ প্রিন্ট সংস্করণ
চট্টবাণী: সম্পত্তিতে নারীর অধিকার আজকাল অনেকটাই অন্ধকারে আবৃত। এর প্রধান কারণ হলো সমাজে ছেলেসন্তানকে বংশের প্রকৃত উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য করা এবং বিয়ের পর মেয়েরা ভাইয়ের কর্তৃত্বে থাকা ও বাপের ভিটিতে অতিথি হিসেবে আসা-যাওয়া করা। একজন পুরুষ স্বাভাবিকভাবে উত্তরাধিকারসূত্রে পিতা-মাতার সম্পত্তি থেকে যেরকম অংশ পায় নারীর অংশ তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। একজন নারী সন্তান হিসেবে পিতা-মাতার কাছ থেকে, স্বামী মারা গেলে স্ত্রী হিসেবে স্বামীর কাছ থেকে, মা হিসেবে সন্তানের কাছ থেকে সম্পত্তির অংশ পায়। সবদিক বিবেচনা করলে ইসলামধর্মে নারীর অংশের সম্পত্তি, পুরুষের অংশের সম্পত্তির বণ্টন যৌক্তিকভাবে সমান্তারাল। আমাদের দেশে অধিকাংশ মুসলিম নারী আইন অনুযায়ী তাঁদের প্রাপ্য অধিকার পায় না।
যে কারণে স্বামী মারা গেলে বা বিবাহ বিচ্ছেদ হলে তাদেরকে অনেক কষ্ট ভোগ করতে হয়। বর্তমান সমাজে নারীদের তাঁদের পিতা-মাতার সম্পত্তি থেকে ব্যাপকভাবে বঞ্চিত করা হয়। কখনো-বা সরাসরি বলে দেয়া হয় যে বিবাহের পর মেয়েদেরকে কোনো প্রকার সম্পত্তি দেয়া হবে না। ইসলামধর্মে মিরাস-ব্যবস্থায় নারীর হিস্যা সংরক্ষিত বিধায় মুসলিম নারীকে সম্পত্তিতে প্রাপ্য অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। শুধুমাত্র বুঝার জন্য কয়েকটি প্রাপ্যতা উপস্থাপনের প্রয়াস আমার।
১. একজন মেয়েসন্তান মা হিসেবে কখনো পুরো সম্পত্তির তিন ভাগের এক ভাগ পায়, আবার কখনো ছয় ভাগের এক ভাগ।
২. একজন মেয়েসন্তান, দাদী ও নানী হিসেবে পুরো সম্পত্তির ছয় ভাগের এক ভাগ পায়।
৩. একজন মেয়েসন্তান, কন্যা হিসেবে কখনো পুরো সম্পত্তির অর্ধেক পায়, দুই বা ততোধিক কন্যা হলে সবাই মিলে তিন ভাগের দুই ভাগ পায়। আর ভাইয়ের সাথে থাকলে ভাইয়ের অর্ধেক পায়।
৪. একজন মেয়েসন্তান, পৌত্রী হিসেবে দাদার সম্পত্তি থেকে কখনো অর্ধেক পায়, কখনো ছয় ভাগের এক ভাগ এবং পৌত্রের সাথে হলে পৌত্রের অর্ধেক পায়।
৫. একজন মেয়েসন্তান, সহোদরা বোন হিসেবে কখনো অর্ধেক পায়। দুই বা ততোধিক হলে তিন ভাগের দুই ভাগ পায় এবং সহোদর ভাই সাথে থাকলে ভাইয়ের অর্ধেক পায়।
৬. একজন মেয়েসন্তান, বৈমাত্রেয় বোন হিসেবে কখনো অর্ধেক পায়, কখনো ছয় ভাগের এক ভাগ এবং একাধিক থাকলে তিন ভাগের দুই ভাগ পায়। ভাই সাথে থাকলে ভাইয়ের অর্ধেক পায়।
৭. একজন মেয়েসন্তান, বৈপিত্রেয় বোন হিসেবে কখনো ছয় ভাগের এক ভাগ পায়, একাধিক থাকলে তিন ভাগের এক ভাগ পায়।
৮. একজন মেয়েসন্তান, স্ত্রী হিসেবে কখনো চার ভাগের এক ভাগ, কখনো আট ভাগের এক ভাগ পায়। (এ বিষয়ে মুসলিম পারিবারিক সম্পত্তি বণ্টন আইন দেখা যেতে পারে)
বৃদ্ধাবস্থায় মাতা-পিতা পুত্রদের আশ্রয়ে থাকার কারণে জ্ঞাত-অজ্ঞাতে নিজের সম্পত্তি পুত্রদের লিখে দেয়। কন্যাদের বঞ্চিত করে পুত্রদের সম্পত্তি দেয়ার ঘটনা দেশে কম নয়। আবার পিতার সম্পত্তি এজমালি থাকলেও সম্পত্তির অধিকার মেয়েদেরকে ভাইয়েরা বণ্টন করে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাইয়েরা দয়াপরবশ হয়ে দিলে পায়, না দিলে মনোমালিন্য করে মেয়েরা বাপের সম্পত্তি আদায় করতে চায় না। আবার বিচার-আচার কিংবা মামলা করে সম্পত্তি আদায় করা বিদ্যমান আইনিব্যবস্থায় খুব একটা সম্ভব নয়। পিতা-মাতা কর্তৃক সম্পত্তি বণ্টন হলে মেয়েরা পৈতৃক সম্পত্তির অংশ অনায়াসে পেয়ে থাকে। মেয়েদের সামাজিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতেই পিতৃ-মাতৃ সম্পত্তি পাওয়া না পাওয়া অনেকটা নির্ভর করে। তবে ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে সেটা খুবই নগণ্য। শহরে বসবাসরত অনেক নারী স্বামীর মৃত্যুর পর বাধ্য হয়ে স্বামীর ভিটায় আশ্রয় নেয়ার জন্য ছুটে যান শ্বশুরবাড়িতে। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির স্বজনরা স্বামীর ভিটায় আশ্রয় না দেয়ার জন্য নানান কৌশল অবলম্বন করে। যেমন স্বামী তার সম্পদ ভাইয়ের ছেলেকে লিখে দিয়েছে কিংবা তার স্বামীর সম্পত্তির অংশটুকু বিক্রি করে দিয়ে গেছে। তাছাড়া রয়েছে সম্পদ বন্ধক দেয়া, জাল দলিল সৃজন করা ইত্যাদি কারণে নারীরা সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাছাড়া মেয়েদের বিয়ের পর মা-বাবার মৃত্যু হলে বাড়ির সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ সমস্যা দেশের গ্রামাঞ্চলে এবং মধ্যবিত্ত সমাজে প্রকট। পিতার সম্পত্তি থেকে নারীদের বঞ্চিত করার অজস্র ঘটনা ও দৃষ্টান্ত আমাদের সমাজে রয়েছে। আইনি দীর্ঘসূত্রতা এবং আইনের আশ্রয় মামলা-মোকদ্দমায় অধিক অর্থ বিনিয়োগের কারণে তারা আইনের আশ্রয়ের উপর নিভর্রশীল হতে পারে না। আমাদের আইন-আদালতে সুবিচার পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাও কষ্টসাধ্য। তাছাড়া মামলা-মোকদ্দমা অনেকে অর্থনাশে ফতুর হয়েছে।
কথায়-আশ্বাসে মনে হবে দ্রত সম্পত্তির অধিকার ফিরে পাওয়া যাবে কিন্তু সহজেই তা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। বাস্তবে যুগের পরিসমাপ্তিতেও মামলার নিষ্পত্তি হয় না। বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন এবং স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্টের যৌথভাবে পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ নারীর কোনো সম্পত্তি নেই। ২৯ শতাংশ নারী উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পত্তি পেলেও সেই সম্পত্তি তাদের অধিকারে নেই। সঠিকভাবে সম্পত্তি বণ্টন হলে এমনটা হতো না। অনেকে বোনদের কাছ থেকে মিরাসের হিস্যা মাফ করিয়ে নেয়। মনে রাখতে হবে, বোনদের কাছে মাফ চেয়ে দায়মুক্ত হওয়া যাবে না। জাহেলিপ্রথা ও রেওয়াজের কারণে মেয়েরা নিজেরাও সম্পত্তি চাওয়াকে দোষ মনে করে। তারা মনে করে প্রাপ্য সম্পত্তি নিলে ভাইয়েরা অসন্তুষ্ট হবে, সমাজের লোকে নিন্দা করবে। বাপের বাড়ির যাওয়া-আসা বন্ধ হয়ে যাবে। বিভিন্ন উপলক্ষে ভাইরা বোনদেরকে দাওয়াত উপহার আর দিবে না। আবার অনেকে স্বচ্ছল থাকায় হিস্যার প্রয়োজন আপাতত নেই মনে করেন এবং অনেকে সামাজিক রেওয়াজের কারণে দাবি করা থেকে বিরত থাকে বা দাবী করার সাহস করে না। বর্তমান সময়ে এটা অপরিহার্য যে, বোন দাবি না করলেও ভাই তাদেরকে তাদের অংশ বুঝিয়ে দিবে, এটা ফরয। এ বিষয়ে কোনোরূপ অবহেলা করা যাবে না। আর ভাই যদি অবহেলা করে তাহলে বোনের কর্তব্য, নিজের হক দাবি করা। সমাজে ভাইয়েরা বোনদের সম্পত্তি না দেয়ার জন্য বিভিন্ন টালবাহনা করে। বিভিন্ন উপলক্ষে ভাই কর্তৃক বোনদের দেয়া উপহারের বিপরীতে ভাইয়েরা বোনের সম্পত্তির অংশ নিতে চায় কিংবা ভাইদেরকে দিয়ে দেয়। উপহার আদান-প্রদান কিংবা আত্মীয়তা টিকিয়ে রাখার নিমিত্তে সম্পত্তি না দিয়ে ভোগ করা কোনো ধরনের সম্পর্ক নয়। যারা বোনদেরকে বিভিন্ন অজুহাতে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে তারা প্রকৃতপক্ষে বোনের হক ও আত্মীয়তার হক কোনোটাই আদায় করে না। মেয়েরা নিজের অধিকার দাবি করলে এবং তা দেয়া হলে তার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা বড় মূর্খতা। ধর্মীয় দৃষ্টিতে কবিরা গুনাহ। অনেক পরিবারে দেখা যায়, বোনের সম্পত্তি দাবিতে ভাইয়েরা বলে, বিয়ের সময় আসবাবপত্র এবং খরচের বিপরীতে সম্পত্তি বিনিময় হয়ে গেছে। এভাবে নয়ছয় করে বোনের সম্পত্তি ভোগ করা এক ধরনের সামাজিক অপরাধ। পিতা-মাতা জীবদ্দশায় সন্তানদেরকে যা দিয়ে থাকেন তা হাদিয়া বা উপহার হিসেবে গণ্য। সম্পত্তির সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। উপহার অনির্দিষ্ট বস্তু যার পরিমাণ ও মূল্য অনির্দিষ্ট এবং অজানা। এর নাম সম্পত্তি বিনিময় নয়। তাই নারীর সম্পত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা করা পারিবারিক, সামাজিক সর্বোপরি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হওয়া উচিত।
লেখক : কলামিস্ট ও সংগঠক