• শিল্প-সাহিত্য

    সফলতার অনেক পিতা, ব্যর্থতা এতিম : ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

      প্রতিনিধি ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ , ৯:৩৫:৫৪ প্রিন্ট সংস্করণ

    0Shares

    চট্টবাণী: সভ্যতা কী? অসভ্যতা বর্বরতা যেখানে নেই সেটাই সভ্যতা। পাশবিকতা ও মানবিকতা দুটি বিষয় আছে। সমাজের যুগোপযুগী কল্যাণ সাধনে ব্যর্থ হওয়ায় গ্রীক এবং রোমান সভ্যতার মত বড় বড় সভ্যতাও হয়ে যায় ইতিহাস। মূল্যবোধের উন্নতি হলে জাতি সভ্য হয়। চাল ডালের সংকটের চেয়ে নৈতিক মূল্যবোধের সংকট অনেক বড়। সকল ধর্ম দর্শন সভ্যতার মূল কাজ প্রতিহিংসা নিবারণ করা। সমাজের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে কিন্তু প্রতিহিংসা থাকলে সমাজ সভ্য হতে পারে না।

    আমরা সমাজ ও রাষ্ট্র হতে অনেক কিছু চাই কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রকে কিছু দিতে চাই না। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডী রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্র হতে কে কী পেয়েছো তা বড় কথা নয়, আগে চিন্তা করো রাষ্ট্রকে কে কী দিয়েছো’। নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের জন্য কোন দায়িত্ব পালন না করলে রাষ্ট্র হতে কিছু চাওয়ার অধিকার থাকে না। নেতাজী সুভাস বসু বলতেন, ‘আদর্শকে ষোল আনা পাইতে হইলে নিজের ষোল আনা দেওয়া চাই’। সমাজ হতে নেওয়ার চিন্তা করি, দেওয়ার চিন্তা করি না। সমাজকে দিলে কতটুকু দিলাম সে চিন্তায় ব্যস্ত থাকি কিন্তু কতটুকু সমাজ হতে গ্রহণ করলাম তা ভাবি না।

    ঠাকুর অনুকুল চন্দ্র বলতেন, ‘তোমরা যতটুকু দিয়েছো তা মেপে দেখনা, মেপে দেখলে অনেক পিছে যেতে হবে।’ যারা সমাজকে উজাড় করে দুই হাতে দেয় তারা সাধারণ নন, অসাধারণ মানুষ।

    হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অসাধারণ একটি প্রার্থনা ছিল। তিনি প্রার্থনা করতেন, ‘আমার জীবনটা যেন হয় সাধারণ আর মৃত্যুটা যেন হয় অসাধারণ’। প্রকৃত সফল মানুষের চরিত্র হলো, ‘সিম্পল লিভিং হাই থিংকিং’ জীবনযাপন সাধারণ আর চিন্তা চেতনা হবে অসাধারণ। এখন আমাদের জীবন হলো, ‘হাই লিভিং সিম্পল থিংকিং’ জীবন যাপন অসাধারণ আর চিন্তায় সাধারণ। সাহিত্যিক অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ লেখেছেন, ‘আমাদের কালে আমরা কাঁচা ঘরে বাস করে লেখাপড়া করেছি পাকা আর আজকের প্রজন্ম পাকা ঘরে বাস করে লেখাপড়া করে কাঁচা’। পাকা ঘরে বাস করলে পাকা হয় না। পাকা হতে আগুনে জ্বলে পুড়তে হয়।

    ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম বলেছেন, ‘সূর্যের মতো দীপ্তমান হতে হলে প্রথমে তোমাকে সূর্যের মতোই পুড়তে হবে। কঠিন বাধা অতিক্রম করে সূর্যের মতো পুড়ে মানুষ খাঁটি হয়। আবদুল কালাম আরো বলেছেন, ‘জীবন কঠিন বাধাসমূহ আসে তোমাকে ধ্বংস করতে নয়, আসে তোমার ভেতর লুকানো অমিত শক্তি ও সম্ভাবনাকে অনুধাবন করতে, বাধাসমূহকে দেখাও যে তুমিও কম কঠিন নও’।

    মানুষের রয়েছে মহান আল্লাহর প্রদত্ত প্রচণ্ড শক্তি। মানুষকে কোন শক্তি আটকাতে পারে না, মানুষ যদি নিজকে নিজে না আটকায়। নিজের ক্ষতি নিজে না করলে কেউ বড় ক্ষতি করতে পারে না। অপরের ক্ষতিটা সাময়িক আর নিজের ক্ষতির প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী। মানুষের রয়েছে অসাধারণ ক্ষমতা। সে ক্ষমতার ম্যাসেজ মানুষ জানে না। জানলে মানুষ কখনো হতাশ হতো না। হতাশা অনেক সংগ্রামী জীবন ধ্বংস করেছে। হতাশা কিছুই দেয় না, শুধু আশাগুলো বিনষ্ট করে দেয়। পরাজয় বলতে কিছু নেই। জিতবে না হয় শিখবে। মনে রাখতে হবে সফলতার অনেক পিতা আর ব্যর্থতা এতিম। সফল হতে সফলতার মন্ত্র জানতে হবে। স্বপ্ন দেখতে হবে,বড় স্বপ্ন দেখতে হবে,কারণ ছোট স্বপ্ন দেখা অপরাধ। দুনিয়ার একজন বড় ধনকুবের নিকট প্রশ্ন করা হলো, বড় স্বপ্ন কোনটি?তিনি বলেছিলেন,যে স্বপ্নের কথা শুনে তোমার বন্ধুরা হেসে উঠবে না সেটি বড় স্বপ্ন নয়।

    আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন স্কুলের ছাত্র ছিলেন, তখন এক শিক্ষক তাঁকে প্রশ্ন করেন, বড় হলে কী হতে চাও? তিনি বলেছিলেন, ‘আমেরিকার প্রেসিডেন্ট’। উত্তর শুনে ক্লাসের বন্ধুরা হেসে উঠেন। এই হাসির কারণ একটি নয়, তিনটি। ওবামা বিদেশি, বিধর্মী এবং কৃষ্ণাঙ্গ। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ভবনের নাম ‘হোয়াইট হাউস’ এই সাদা ঘরে কোনদিন কালো মানুষ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি। বন্ধুরা ক্লাস রুমে যতই হাসুক ওবামা জেদ করলেন। তিনি আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হবেনই। তিনি ধর্ম ত্যাগ করলেন, দেশ ত্যাগ করলেন। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গরা ভোটার হতো না। তিনি নিজের খেয়ে, নিজের পরে তাদের ভোটার করলেন, তারাই ওবামাকে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত করলেন। মাত্র ৪১ বছরে ওবামা একদিন হয়ে গেলেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি। তিনি প্রমাণ করলেন যত বাধা থাকুক মানুষ চাইলে আমেরিকার রাষ্ট্রপতিও হতে পারেন। সফলতা কারো ৪১ বছরে আগে আর কারো আসে ৭১ বছর বয়সে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ৭১ বছর বয়সে।

    সফলতা কারো দরজায় কড়া নাড়ে, আর কেউ ডেকে আনতে হয়। যে সফলতা দরজায় কড়া নাড়ে মানুষ তাকে বলে ‘ভাগ্য’। ভাগ্যকেও ডেকে আনতে হয়। কেউ কম পরিশ্রম করে অধিক অর্জন করে আর কেউ বেশি পরিশ্রম করে কম অর্জন করে। কিন্তু পরিশ্রম ব্যতীত সফলতা আসে না। মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, আল্লাহ কোন জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করে না, যে জাতি নিজের ভাগ্য পরিবর্তন নিজেই করেনা না। (সূরা রাদ, আয়াত: ১১) কোরআনে পাকে মহান আল্লাহ পাক আরো ঘোষণা করেছেন, ‘ওয়া আল লাইসা লিল ইনসানে ইল্লা মাসাআ’। প্রচেষ্টা ব্যতীত মানুষের জন্য কিছুই নেই। (সূরা: নজম: আয়াত: ৩৯)।

    আমরা চাইলে পৃথিবীটা বদলাতে পারবো না, কিন্তু চেষ্টা করলে আমাদের ভাগ্যটা বদলাতে পারি।মানুষের সহজ কাজ হলো অন্যের সমালোচনা করা আর কঠিন কাজ হলো নিজেকে বদলানো,নিজের ভাগ্যকে বদলানো। কোন কাজটি কঠিন? যে কাজটি যে ব্যক্তি জানে না, পারে না, সেটি তার জন্য কঠিন। যে মানুষ বিমান নির্মাণ করেন, পারমাণবিক বোমা তৈরি করে, তার জন্য সেটি সহজ কাজ। যে ব্যক্তি কঠিন কাজটি জানেন, করতে পারেন, তার জন্য তা সহজ। যে ব্যক্তি ভাগ্য বদলাতে পারেন সেটি তার জন্য কঠিন নয়। বাঙালি সফল না হওয়ার অনেক কারণ। তার মধ্যে বড় কারণ হলো এ জাতির অর্ধেক জীবন চলে যায় পরচর্চায় তাই বাকী জীবন অসম্পূর্ণ রেখে চলে যেতে হয়। বেশীর ভাগ পরচর্চা হয় ইর্ষা- হিংসা হতে। বাংলায় একটি কথা আছে, ‘অক্ষমের ঈর্ষা। অর্থাৎ আমি যা পারি না, যা আমি করতে অক্ষম, তা অন্য কেউ করতে দেখলে ঈর্ষান্বিত হওয়ার নাম ‘অক্ষমেই ঈর্ষা’। হিংসুক যতই জ্বলে মরুক হিংসার আগুনে, আমাদের দৃষ্টি চাতকের মত উপরে থাকতে হবে। সামনের দিকে যেতে হবে। মহাত্মাগান্ধী বলেছেন, ‘তুমি যখন ভালো কিছু করবে তখন তোমাকে দেখে কিছু মানুষ হাসবে। তারপর হিংসা করবে, এরপর বাধা দিবে, তারপর তুমি সফল হবে।
    লেখক: কলাম লেখক, রাজনীতিক।

    0Shares

    আরও খবর 32

    Sponsered content