• সাহিত্য

    ঘাতক নয়, বিশ্বাসঘাতক চেনা কঠিন: ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

      প্রতিনিধি ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ , ৯:২৩:৪৭ প্রিন্ট সংস্করণ

    চট্টবাণী: বর্তমান সময়ে লাভ আর লোভ মানুষকে উন্মাদ করে ছাড়ছে। এখন সমাজে দেখছি বাঘ রক্তের গন্ধে যে রূপ হিংস্র হয় তার চেয়ে টাকার গন্ধে মানুষ বেশী হিংস্র হয়ে উঠছে। টাকা না থাকলে এখন মানুষ আত্মীয়তাও করতে চায় না। চরিত্রবান জ্ঞানীর হাতে কন্যা অর্পণ করতে তথাকথিত ভদ্র সমাজ ইচ্ছা পোষণ করে না। অথচ মুসলমান হিসেবে দাবী করি আমরা মহানবী হযরত মোহাম্মদ (দ.)’র অনুসারী। প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (দ.) তাঁর আদরনীয় কন্যা হযরত ফাতেমা (রা.) কে আরবের সেবা ধনীর নিকট বিয়ে দিতে পারতেন। সেরা ধনীকে না দিয়ে দরিদ্র জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব হযরত আলী (রা.)’র নিকট বিয়ে দিয়েছিলেন। যাঁর ঘরে সংসার চালানোর কিছু ছিল না। আজ মুসলমানগণ মেয়েকে জ্ঞানীকে নয়, ধনীকে বিয়ে দেয়।

    আয় যে পথেই হোক সমস্যা নেই, অঢেল অর্থের মালিক হলে সমাজের হর্তাকর্তা বিধাতা বনে যায়। মদ আর মধু এক নয়, মধু হালাল আর মদ হারাম। এ সমাজে এখন মদ আর মধুর পার্থক্য করা হায় না। আত্মসন্তুষ্টি বিদায় নিছে। যে ভাবে, যত ভাবে অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার নেশা জাতিগত রোগে পরিণত হয়েছে। বিখ্যাত ‘ইয়েস’ ম্যাগাজিন সুখি হওয়ার বিজ্ঞানভিত্তিক উপায় বের করে একটি পিচার প্রকাশ করে। মুখি হওয়ার কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে আত্মসন্তুষ্টি একটি। যাকে আমরা বলি ‘সবর’ ইসলামের শিক্ষা হলো কোন কিছুর প্রাপ্তিতে শোকর করবে, আর অপ্রাপ্তিতে সবর করবে। সবর আর শোকর মানুষকে সুখি করে। ‘ইয়েস’ সাময়িকী সুখি হতে হলে দুঃখের সময় হাসতে হবে, সব সময় কৃতজ্ঞ হওয়া, পরের কল্যাণে আনন্দ ও দান করা সুখি মানুষের লক্ষণ বলেছেন। সুখি হতে হলে সুন্দর একটি মন থাকা প্রয়োজন। দুনিয়াতে সে-ই ধনী যার সুন্দর একটি মন আছে। মন হলো মানুষের পাওয়ার পয়েন্ট। মনের পরিবর্তন হলো প্রকৃত পরিবর্তন। সমস্ত নবী রাসুল (দ.) সকল মহামানবের মূল কাজ ছিল মনকে পবিত্র করা।

    স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘মন কোন ডাস্টবিন নয়, যেখানে রাগ, ঘৃণা ও ইর্ষা জমা রাখতে হবে, এটি একটি অমূল্য সম্পদে ভরা বাক্স, যেখানে থাকবে সুখ, ভালোবাসা আর মিষ্টি স্মৃতি’। আজ আমরা বিষ ও বিদ্বেষ মনে লালন করে মনটাকে কলুষিত করছি। সব বিষধর প্রাণী অন্তরে বিষধারণ করে না, মানুষই একমাত্র প্রাণী যে অন্তরে বিষ ধারণ করে। বিষমুক্ত হতে পারলে একজন মানুষ প্রকৃত সার্থক হন। অন্তরের বিষ নিবারণ করতে সমস্ত ধর্ম দর্শন নীতি নৈতিকতার শিক্ষার প্রয়োজন হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতার কয়েকটি পংক্তিতে এই কথাটি সুন্দরভাবে উচ্চারণ করেছেন ‘ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে / দয়াহীন সংসারে,/ তারা বলে গেল ‘ক্ষমা করো সবে’ বলে গেল ‘ভালোবাসো’ / অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো’। আগুন দিয়ে আগুন নিবানো যায় না, হিংসা দিয়ে হিংসা নিবারণ করা যায় না। হিংসা দ্বারা অপরের ক্ষতি করা যায় কিন্তু নিজের উন্নতি করা যায় না। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (দ.) ঘোষণা করেছেন, প্রত্যেক পাপে দুনিয়ায় একটি উপকার আছে। যেমন আপনি নামাজ পড়েননি তাতে শারীরিক সুখ পেয়েছেন, যাকাত দেননি, দান করেননি টাকা বাঁচলো, মদ পান কারে, নেশা সেবন করে, নারী ভোগ করে,শারীরিক শান্তি পেলেন, মিথ্যা বললেন, অপরাধ হতে মুক্তি পেলেন ইত্যাদি। কিন্তু এমন একটি পাপ আছে যে পাপের শাস্তি দুনিয়া ও আখিরাতের উভয় জাহানে ভোগ করতে হবে। তা হলো ‘হিংসা-ইর্ষা’। ইর্ষাপরায়ন ব্যক্তি পরের উন্নতি দেখে ইহকালে মনের আগুনে জ্বলে, পরকালে জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। যে মন ইর্ষার আগুনে জ্বলবে সে মন কোনদিন সুখি হতে পারবে না। অন্য একটি হাদিসে ইরশাদ আছে, ইর্ষাপরায়ন ব্যক্তির শাস্তি তিনটি (যদিও কোন পাপের শাস্তি তিনটি নেই) (১) ইহকালে সে মনের আগুনে জ্বলবে। (২) পরকালে জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। (৩) সমাজের মানুষ নিন্দা করবে। সমাজের মানুষ বলবে লোকটি মন খুবই খারাপ,লোকটি হিংসুটে। হিংসমুক্ত মানুষই প্রকৃত মানুষ। জন্মিলে মানুষ হয় না, মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মানুষ সবার ঘরে জন্মায়, মনুষ্যত্ব সবার ঘরে জন্মায় না’। মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। মানুষকে বুঝা মুশকিল, মানুষের ভাষা বুঝা কঠিন। এখন মানুষের কোন কথাটি মুখের আর কোন কথাটি বুকের তা বুঝা যায় না। অধিকাংশ মানুষ প্রশংসা করে লোভে, সমালোচনা করে হিংসায়, সম্পর্ক করে স্বার্থে। বর্তমান কোনটি প্রশংসা, কোনটি তৈলমর্দন, কোনটি উৎসাহ-অনুপ্রেরণা তা বুঝা কঠিন। সমাজের কাজ হলো ব্যর্থ মানুষের সমালোচনা করা, সফল মানুষকে ইর্ষা করা আর সফল মানুষের সামনে গেলে তোয়াজ করা।

    মানুষের আজব চরিত্র আমার নিকট উদ্ভুত লাগে। মানুষ নিজেকে ভালো মানুষ মনে করে, খারাপের সামলোচনা করে, আবার অধিকাংশ মানুষ খারাপ লোকের পিছনে থাকে। প্রত্যেক মানুষ নিজের বেলায় আইনজীবী আর পরের বেলায় বিচারক। নিজের দোষ দেখিনা অথচ পরের দোষ নিয়ে চর্চা করি, অথচ সফল মানুষ, সার্থক মানুষ,মূল্যবান মানুষ হলো একজন ভালো মানুষ। ভালো কথার সাথে ভালো চিন্তা, ভালো কর্ম করলে তিনিই মূল্যবান মানুষ। ভালো মানুষকে সমাজের অধিকাংশ মানুষ ভালোবাসেনা, কিন্তু মহান আল্লাহ পাক ভালোবাসেন। ভালো মানুষ শুধু শুধু নিজেরা ভালো থাকতে চায় না, সবাই ভালো থাকুক তা চায়। ভালো মানুষ সব সময় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির হয়ে থাকে। ভালো মানুষ শুধু নিজের উন্নতিতে আনন্দিত হয় না, অপরের উন্নতিতেও আনন্দিত হয়। সব জাতির নিকট নেতিবাচক মানুষ আছে কিন্তু বাঙালির নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বেশি। বাংলা ভাষার প্রথম বর্ণমালা ‘অ’। প্রথম বর্ণটিই নেতিবাচক। নেতিবাচক বর্ণ দিয়ে আমাদের শিক্ষা শুরু হয়। ‘অ’ দ্বারা ভালো মন্দ হয়ে যায়,ইতিবাচক নেতিবাচক হয়ে উঠে। যেমন- অমানুষ, অসুন্দর, অকাজ, অরুচি, অসুখ ইত্যাদি। আজকের সমাজে গালি আর তালি দেওয়ার লোকের অভাব নেই, কিন্তু ভালো চিন্তা, ভালো কর্মের লোকের অভাব আছে। বাঙালি নিজের উন্নতির জন্য যত সময় ব্যয় করে না তার চেয়ে অধিক সময় ব্যয় করে অন্যের ক্ষতির জন্য। আমরা উপকারের প্রতিদান দিতে জানিনা উপকারের পরিবর্তে অপকার করে প্রতিদান দিই। বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস কম নয়। ঘাতক চেনা সহজ, বিশ্বাস ঘাতক চেনা বড় কঠিন।
    লেখক: কলাম লেখক, রাজনীতিক।