প্রতিনিধি ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ , ১১:৫৮:৩৪ প্রিন্ট সংস্করণ
চট্টবাণী: সত্যের পথে চলা কঠিন। নীতি নৈতিকতা নিয়ে বর্তমান সময়ে সত্যের পথে চলা আরো কঠিন। সত্যের পথে চলতে গিয়ে নবী রাসুল (দ.),পীর আউলিয়া, সাধকরা কঠিন কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। সত্য ধারন করা সহজ নয়। সত্যের জন্য সক্রেটিসকে প্রাণ দিতে হয়েছে। যারা তাঁকে প্রাণদণ্ড দিয়েছে তারা সেদিন ভেবেছিল তারা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। ইতিহাসই প্রমাণ করে তারা সত্যের উপর ছিল না। সক্রেটিস জানতেন, সত্য প্রমাণ করতে কখনো কখনো মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়। সক্রেটিস সেদিন মৃত্যুকে গ্রহণ না করে পালিয়ে যেতে পারতেন কিন্তু পালিয়ে যাননি, কারণ তিনি জানতেন তিনি যদি পালিয়ে যান তাহলে একদিন সত্য মিথ্যা হয়ে যাবে, মিথ্যা সত্য হয়ে যাবে। সক্রেটিস যদি সত্যের পথ ত্যাগ করে আপোস করতেন, আর তাঁর ছাত্র প্লেটো যদি সক্রেটিসের উপর অর্পিত অবিচার দেখে নিবৃত হতেন। তাহলে দুনিয়াবাসী প্লেটো-সক্রেটিস এরিস্টটল-আলেকজান্ডার পেতো না। গ্রীক দর্শন বলতে কিছুর অস্তিত্ব থাকতো না। সত্যের কথা উচ্চারণ করতে গিয়ে সেদিন একজন মানুষও সক্রেটিসের পক্ষে (সত্যের) দাঁড়াননি। হেমলক বিষভর্তি পেয়ালা তাঁর হাতে তুলে দিয়েছে। সক্রেটিসের পক্ষে (সত্যের) পক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন ইতিহাস।
সক্রেটিসের মৃত্যুর আড়াই হাজার বছর পর গ্রীক আদালত রায় প্রদান করে তিনি নির্দোষ দিলেন। হাজার বছর পরও সত্য প্রতিষ্ঠিত হবেই। মিথ্যাকে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, প্রতিষ্ঠিত করা যায় না, সত্যকে সাময়িক গোপন করা যায় কিন্তু বিলুপ্ত করা যায় না। আমরা সত্যের কথা শুনি, কিন্তু সত্যের পথে চলতে পারি না। কারণ কান দিয়ে শুনি, মন দিয়ে নয়,তাই আমাদের সত্যের কথা মনেই থাকে না। কথাগুলো ধারণ করতে পারি না।মনের কান দিয়ে শুনলে ধারণ করতে পারতাম। সত্যের কাজ করতে পারতাম। সমাজ পরিবর্তন হতো।
এখন আমরা কোন পদে আছি বা কোন পদ পাবো সবার সে চিন্তা। আমরা কী কাজ করছি, কী কাজ করতে পারবো সে চিন্তা নেই। সমাজের যতটা ক্ষতির চিন্তা আমাদের মাথায় ততটা উপকারের কথা মাথায় নেই। নেতা হতে নীতি লাগে। নীতিবানদের এখন কেউ পছন্দ করে না। সৎ মানুষ নির্বাচনে প্রার্থী হলে তাকে কেউ ভোট দেয় না। দলীয় প্রার্থী এবং টাকাওয়ালাকে সবাই ভোট দেয়, পাকিস্তান আমলে সংসদের এক সদস্য স্পীকার তমিজ উদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘মাননীয় স্পীকার দিন দিন খারাপ নেতার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে’ স্পীকার বললেন, পাতলা দুধে পাতলা সর পড়ে ? জাতির চরিত্র যেরূপ নেতাও সে রকম জন্ম নেয়। সত্যি আজ আমরা ভালো মানুষকে সম্মান করি না, ভোট দিই না। কিন্তু মুখে ভালো মানুষের পক্ষে বলি। জনগণের নৈতিক যে দায়িত্ব পালন করা দরকার তা আমরা করি না। আমরা ক্ষমতা আর টাকার পূজা করি। হযরত মওলানা আলী (রা.) বলেছেন, ‘মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে ভালোবাসার জন্য, আর বস্তুকে সৃষ্টি করেছেন, ব্যবহারের জন্য’। বর্তমান যুগে আমরা মানুষকে ব্যবহার করি আর টাকার মত বস্তুকে ভালোবাসি। দরিদ্রতা মানুষকে যেমন ঈমানহারা করে তেমনি অধিক অর্থবিত্তের নেশা মানুষের ঈমান নষ্ট করে।
চীনের দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছেন, ‘মাত্রাতিরিক্ত সবই বিষ’। সব নেশাই খারাপ। টাকার নেশা আরো খারাপ। মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি বলেছেন, ‘মশারীর নীচে জিকির করা সহজ, কিন্তু টাকার স্তূপের উপর ঈমান ঠিক রাখা কঠিন।’ লোভের কোন শেষ নেই। লোভের লাগাম টানা কঠিন। আজ যা চাই তা পেয়ে গেলে লোভের কী মৃত্যু হবে ? কখনো না। ১০ বছর আগে যা চেয়েছি তার চেয়ে অধিক পাওয়ার পর লোভ কী কমছে ? না কমেনি, আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। লোভীর লোভের শেষ নেই। লোভী মানুষ পুরো দুনিয়ার মালিক হলে সে মঙ্গল গ্রহ জয় করে তার মালিক হতে চাইবে। আবু লাহার অর্থ অগ্নির পিতা, মানুষ কখনো অগ্নি হতে পারে না। আগুন লোভের প্রতীক, অহংকারের প্রতীক। শয়তান আগুণের তৈরি। মানুষের মধ্যে আগুন যেমন আছে, আবার পানি মাটি বাতাসও আছে। কখনো কখনো মানুষ শয়তানের প্ররোচনায় আগুণের শক্তিকে শক্তিমান হয়ে উঠে। তখন এই আগুন দ্বারা সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে। আগুনের শক্তি তীব্র হতে আরো তীব্র হয়। তেমনি মানুষ সবকিছু পাওয়ার পর আরো লোভ বেড়ে যায়। প্রত্যেক লোভী মানুষের পিতা আবু লাহাব। কারণ আবু লাহাব অর্থ অগ্নির পিতা।
আজকের দুনিয়ায় প্রচুর শিক্ষিত মানুষ আছে। দিন দিন শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। শিক্ষিত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, বিজ্ঞানীর অভাব নেই। তারপরও সমাজটা দিন দিন অন্ধকারের কানা গলি প্রবেশ করছে কেন !
মানুষ চাইলে খুনি হতে পারে, আবার জ্ঞানীও হতে পারে। কে কোনটা চয়েস করলো তা বড় বিষয়। ঘুষ সুদ চুরি আত্মসাৎ অন্যায় শিক্ষিত মানুষের নেশায় পরিণত হয়েছে। এক জরিপে দেখা গেছে শিক্ষিত মেধাবীদের মধ্যে অমানুষ বেশি। বাংলায় একটা কথা আছে, ‘সুন্দরী রমনী যখন রববনীতা হয়, সে বেশি মানুষের চরিত্র নষ্ট করে’। একজন উচ্চ শিক্ষিত মেধাবী মানুষ খারাপ হলে জাতির যত ক্ষতি হয়, ততক্ষতি একজন কৃষক মজুর, শ্রমিক খারাপ হলে করতে পারে না। আজ শিক্ষিত বৃদ্ধিজীবীরা উপদেশ দেন বেশি, সে উপদেশ তারা নিজের জীবনে গ্রহণ করে না। উপদেশের চেয়ে দৃষ্টান্ত অনেক ভালো।তাদেরকে বলি আগে নিজে করে দেখান, তারপর উপদেশ মহাদেশ সবই দিতে পারেন। বিজ্ঞান প্রযুক্তির উন্নতির কালে মানুষ্যত্বের অবনতি হচ্ছে। বর্তমান কালে বাড়ছে জনসংখ্যা কমছে মানুষ। বাড়ছে পরীক্ষার্থী, কমছে শিক্ষার্থী। বাড়ছে আইন, কমছে না অপরাধ। বাড়ছে রূপসী কমছে চরিত্রবান। বাড়ছে খাদ্যদ্রব্য, কমছে না ভেজাল। বাড়ছে নেতা কমছে নীতি। সবাই সফলতার পিছনে দৌড়ছে, স্বার্থকতা হারিয়ে যাচ্ছে। ভালো মানুষ হলে জীবনটা সার্থপর হয়। আধুনিক বিজ্ঞানীদের মধ্যে সেরা বিজ্ঞানী হলো আলবার্ট আইনস্টাইন। তিনি বলেছেন, ‘সফল মানুষ হওয়ার চেষ্টা না করে মূল্যবান মানুষ হওয়ার চেষ্টা করো’।
লেখক : কলাম লেখক ও রাজনীতিক।