• সাহিত্য

    আসুন প্রার্থনা করি, আমরা যেন লজ্জা পাই

      প্রতিনিধি ১০ জানুয়ারি ২০২৫ , ১:০১:৩৫ প্রিন্ট সংস্করণ

    ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী: আজ হতে এক দশক আগেও যে বিষয়গুলো আমাদের অনুভূতিকে প্রচণ্ড ভাবে নাড়া দিত, বর্তমান সে বিষয়গুলো স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এটি আমাদের সামাজিক বড় বিপর্যয়। এর দায়ভার সবাইকে নিতে হবে।পশুর সাথে পশুর ঝগড়া বিবাদ হয়, কিন্তু একই জাতীয় পশুকে আরেক পশু হত্যা করে না। ভিন্ন জাতীয় পশুকে হত্যা করে। যেমন কুকুর শিয়ালকে, বাঘ হরিণকে, সিংহ মহিষকে হত্যা করে। হরিণ হরিণকে হত্যা করে না, বাঘ বাঘকে হত্যা করে না। অথচ আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হয়ে মানুষ মানুষকে হত্যা করছে। প্রাচীনকালেও হত্যাকাণ্ড ছিল কিন্তু বাবা-মা সন্তানকে হত্যা করতো না, সন্তান বাবা মাকে হত্যা করতো না। পারিবারিক হত্যার উৎসব শুরু হয়েছে। পশুর জন্য লিখিত অলিখিত কোন আইন নেই, মানুষের জন্য বছরে বছরে রচিত হচ্ছে আইন, সাথে বাড়ছে অপরাধ।

    প্রগতি মানে যার গতি আছে, অগ্রগ্রতির দিকে তাকে বলে প্রগতি। উন্নতি আর প্রগতি এক নয়। উন্নতি মানে উপরে উঠা,এটি খারাপ নয়, কিন্তু সবাইকে নিচে ঠেলে ফেলে উপরে উঠা খারাপ। এখন সবাইকে ঠেলে নিচে নামিয়ে উপরে উঠতে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘যারা নিজের মুক্তি চাইবে, তাদের জীবনেও মুক্তি
    আসবে না, মানুষের মুক্তিতে নিজের মুক্তি’।

    এক সময় যারা মানুষের মুক্তির কথা ভাবতেন তারাই নেতা হাতেন।সোহরাওয়ার্দী, ভাষানী, একে ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধুর মত নেতা জনগণ হতে গড়ে উঠেছিলেন, এখন অনেকে নেতা হয়ে উঠে বিলবোর্ড, পোস্টার, তেলবাজী, অবৈধ অর্থবিত্ত হতে। এক সময় আইনজীবীরা নেতত্ব দিতেন। এখন নেতত্ব তো দূরের বিষয়, মানুষ আইন পেশায় আইনজীবীর পরিবর্তে লাইনজীবী খোঁজে।

    বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যতই উন্নতি হচ্ছে ততই প্রতিযোগিতা বাড়ছে।সবার প্রতিযোগিতা এখন নিজকে নিয়ে, সমাজের মানুষের কথা ভাবার সময় মানুষের নেই। ব্যতিক্রম এখনো আছে। তারা সফল নয়, সার্থক মানুষ। সফল অনেকেই হয় কিন্তু সার্থক হওয়ার ভাগ্য কম লোকের জুটে। চোর ডাকাতও নিজ কাজে সফল, ঋণখেলাপিরাও সফল কিন্তু তাদের জীবনকে সার্থক করতে পারে না।সকল সার্থক মানুষ সফল বলা যায়, কিন্তু সকল সফল মানুষ স্বার্থক নয়। পরের জন্য যে জীবন, সে জীবনই সার্থক। দুনিয়ার সবচেয়ে সহজ কাজ মানুষের ক্ষতি ও সমালোচনা করা, আর কঠিন কাজ মানুষের কল্যাণ করা। সার্থক মানুষের সমালোচক কম নয়। সমালোচনা করতে যোগ্যতা লাগে না। সমালোচিত হতে যোগ্যতা লাগে।

    আমরা নিজের জন্য প্রচুর কাজ করি। প্রতিদিন যদি মানব কল্যাণে একটি করে ভালো কাজ করি তাহলে আমাদের সমাজটা অনেক এগিয়ে যেত। পরের উন্নতির মধ্যে নিজের উন্নতি, এই মানসিকতার লোক যে সমাজে বাড়বে সে সমাজ ততই সভ্য হবে। আমি পরের কল্যাণে এগিয়ে আসলে অন্যরা আমার বিপদে এগিয়ে আসবে। এটিই নিয়ম। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘জগতে যখন এসেছো, একটি দাগ রেখে যাও, না হয় গাছ পালা পাথরের সাথে তোমার পার্থক্য থাকবে না। মাদার তেরেসা বলতেন, ‘তুমি যদি দৃশ্যমান মানুষকে ভালোবাসতে না পারো তবে অদৃশ্য প্রভুকে কী করে ভালোবাসবে’?

    জীবনে আমরা অনেক কিছু করতে পারবো। যদি চিন্তা করি আমার কাজের ফল ভোগ কে করবে? তাহলে জীবনে কিছু করা যাবে না। একটি বাগান সাজানোর দায়িত্ব কেউ নিতে চায় না, কিন্তু সাজানো বাগানের সুযোগ সবাই গ্রহণ করতে চায়। এটি দুনিয়ার নিয়ম। স্কাউটের একটি অসাধারণ কথা আছে, ‘জন্মের সময় আমি সমাজ দেশটাকে যে ভাবে পেয়েছি, মৃত্যুর সময় আরো একটু ভালো দেখে যেতে চাই। এই লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাও’। বর্তমান আমরা নানাভাবে পৃথিবীর প্রতি অবিচার করছি, ফলে সমাজটা যেভাবে অধগতির দিকে যাচ্ছে সে ভাবে যেতে থাকলে মানব সভ্যতা রক্ষা করা কঠিন হবে। পৃথিবীটা আজ কান্না করছে, এই কান্না বুঝার-শুনার মানুষ দেখিনা। সক্রেটিসের নিকট জানতে চেয়েছিলেন, শ্রেষ্ঠ কাজ কোনটি? তিনি বলেছিলেন, দেশ ও মানুষের জন্য কিছু করে যাওয়া। আমরা দুনিয়ার মধ্যে প্রচুর গরিব মানুষ দেখতে পাই, যাদের টাকা ছাড়া কিছুই নেই।

    প্রকৃত ধনী কে তা বিল গেটসের মুখ হতে শুনুন। বিল গেটস যখন দুনিয়া সেরা ধনী তখন এক ব্যক্তি তাঁর নিকট জানতে চাইলেন, পৃথিবীতে আপনার চেয়েও বড় ধনী কেউ আছে? তিনি জানালেন,আছে। তাঁর নিকট জানতে চাইলেন, কে সে ব্যক্তি? বিল গেটস বললেন, আমি যখন ধনী ছিলাম না, তখন নিউইয়র্কের বিমানবন্দরে অবতরণ করে এক পত্রিকার হকার হতে একটি সংবাদপত্র কিনতে চাইলাম, কিন্তু আমার নিকট খুচরা পয়সা ছিল না। তাই পত্রিকাটি হাতে নিয়ে আবার ফেরত দিলাম এবং বললাম, আমার হাতে পত্রিকা কেনার মত খুচরা পয়সা নেই।হকার বললেন, আমি আপনাকে ফ্রিতে দিতে চাই। তাঁর অনুরোধে আমি পত্রিকাটি নিলাম।কাকতালীয় ভাবে ২/৩ মাস পর আবার নিউইয়র্ক বিমান বন্দরে একই ঘটনা ঘটলো। আবার একটি পত্রিকা এই হকার আমাকে জোর করে দিলো। ১৯ বছর পর আমি যখন প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হই তখন দেড় মাস খুঁজে তাঁকে পেলাম। তাঁকে বললাম, আপনি কী আমাকে ছিনেন? তিনি জানালেন হ্যাঁ। আপনি বিল গেটস। আমি বললাম, আপনি এক সময় আমাকে দুইটি পত্রিকা ফ্রিতে দিয়েছিলেন, তা কী আপনার মনে আছে? তিনি বললেন, মনে আছে। আমি বলালম, সে সময় যে সাহায্য আপনি করেছিলেন তার বিনিময় দিতে চাই। আজ আপনি আমার নিকট যা চান তা দিবো। হকার বললো, সেই সাহায্যের বিনিময় হয় না। কারণ আমি যখন দরিদ্র হকার ছিলাম তখন আমি আপনাকে সাহায্য করেছি, আর আপনি যখন বিশ্বের সেরা ধনী হয়েছেন তখন আপনি আমাকে সাহায্য করতে এসেছেন। কী করে আপনার সাহায্যের সাথে আমার সাহায্য মিলাবেন ? সে দিন আমি বুঝেছিলাম পত্রিকার হকার আমার চেয়ে অনেক বড় ধনী ছিলেন। কারণ সাহায্য করার জন্য ধনী হওয়ার অপেক্ষা তিনি করেননি। ধনের চেয়ে যার বড় একটি মন আছে তিনিই প্রকৃত ধনী।
    মেধাবী পি কে হালদার বুয়েটের মেধাবী ছাত্র ছিল। ব্যাংক হতে ১১ হাজার কোটি টাকা মেরে বিদেশে পাচার করলো। অশিক্ষিত সব মানুষ মিলেও এত টাকা ব্যাংক হতে মেরে বিদেশে পাচার করেনি। মেধা আর এসব ধনীরা দেশকে কী দিচ্ছে? তাদের চেয়ে পন্ডমূর্খ মানুষ যার পবিত্র একটা মন আছে সে বড় ধনী।

    নাইজেরিয়ার এক প্রতারক চক্র ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে ‘উপহার প্রতারণা’ করতে গিয়ে র‍্যাবের নিকট ধরা পড়ে। বন্দী নাইজেরিয়ার প্রতারক চক্রের নিকট সাংবাদিক জানতে চাইলেন,এত দেশ থাকতে কেন প্রতারণার কাজটি বাংলাদেশে করতে এসেছো? তারা জানালো, বাংলাদেশি মানুষের চেয়ে বেশি অর্থলোভী মানুষ তারা কোন দেশে দেখিনি। এসব অর্থলোভীদের মধ্যে মূর্খলোকের চেয়ে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। প্রতারক ও প্রতারিতদের মধ্যে শহরের শিক্ষিত, উচ্চপদে চাকুরীরত, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ডেসটিনি, যুবক, ইভ্যালী, ইউনিপে টু, পিপলস লিজিং ইত্যাদি প্রতারণা এবং এমএলএম ধরনের কাজে অধিক যুক্ত হয়। অর্থলোভী শিক্ষিত অমানুষদের কারণে ভিতরের মনুষ্যত্বে নদীটি শুকিয়ে যাচ্ছে। তাদের ক্ষুধার কারণে নদী ও মানবতা শুকিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে জন্তুর ক্ষুধার নিবৃত্তি হয়, মানুষের ক্ষুধার নিবৃত্তি নেই। একজনই সব গ্রাস করে নিতে চায়। প্রকৃত পক্ষে এসব মানুষের চেয়ে নিম্ন শ্রেণীর লোক আর হতে পারে না। লজ্জা নারীর ভূষণ। তাই বলে কী পুরুষের একেবারেই লজ্জা থাকতে নেই? লজ্জা থাকলে এ ধরনের বেহায়া কাজ তারা করে কী করে? এখন দেখি নারীরাও বেহায়াপনা বেলাল্লাপনায় পিছিয়ে নেই। সব অপকর্মে নারী পুরুষ কারো লজ্জা নেই। সমাজে লজ্জা থাকলে এত নির্লজ্জ কাজ করা সম্ভব নয়। আসুন আমরা প্রার্থনা করি আমরা যেন লজ্জা পাই।
    লেখক: কলাম লেখক, রাজনীতিক।

    আরও খবর 23

    Sponsered content