প্রতিনিধি ২৫ জুলাই ২০২৪ , ৯:৫১:৩১ প্রিন্ট সংস্করণ
খেলাধুলা ডেস্ক: বাড়ির পাশে ধুলোময় ধূসর সড়কে যখন অনুশীলন করতেন আফগান সাইক্লিস্ট ইয়ুলদুজ হাশিমি ও ফারিবা হাশিমি, তখন এক পাশ থেকে পাথর ছুড়ে মারতেন পুরুষরা। শুধু তা-ই নয়, সহ্য করতে হয়েছে একের পর এক অপমানের বাণী।
কিন্তু সেসব কোনোভাবেই দমাতে পারেনি দুই বোনকে। কঠোর পরিশ্রমকে পুঁজি করে আজ তারা জায়গা করে নিয়েছেন প্যারিস অলিম্পিকে। দেশের ইতিহাসে প্রথম সাইক্লিস্ট হিসেবে গেমসে আফগানিস্তানকে প্রতিনিধিত্ব করবেন তারা।
রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ২১ বছর বয়সী ইয়ুলদুজ বলেন, ‘আমি ২ কোটি আফগান নারীর প্রতিনিধিত্ব করতে চাই, যারা কি না মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। আশা করি, তাদের কণ্ঠস্বর হয়ে আমি বিশ্বকে দেখাতে পারব আফগান নারীদের কীসব পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয় ও চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও তারা অসাধারণ কৃতিত্ব গড়তে পারে। ‘
২০২১ সালের আগস্ট থেকে আফগানিস্তানে চলছে তালিবান কর্তৃত্ব। পুনরায় সরকার গঠনের পর মেয়েদের শিক্ষা, চাকরি ও খেলাধুলার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তারা। তাই প্যারিস অলিম্পিকে বিশ্বের সামনে আফগানিস্তান ও আফগান নারীদের এক নতুন চিত্র তুলে ধরতে চান ইয়ুলদুজ ও ফারিবা।
এবারের অলিম্পিকে আফগানিস্তানের হয়ে অংশ নিচ্ছেন তিনজন পুরুষ ও তিনজন নারী অ্যাথলেট। ছয়জন অ্যাথলেটই আফগানিস্তানের পুরনো পতাকা সম্বলিত (লাল, সবুজ ও কালো রংয়ে অঙ্কিত) জার্সি পরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। ক্ষমতায় আসার পর যা বদলে দিয়েছিল তালিবানরা। লিঙ্গ-সমতা সম্পর্কে তালিবানদের পরিষ্কার বার্তা দিতেই এভাবে দল ঠিক করেছেন আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি ও আফগানিস্তানের নির্বাসিত অলিম্পিক কমিটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা।
তালিবানের কোনো সদস্যকেই অলিম্পিক গেমসে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। স্বভাবতই হাশিমি বোন ও স্প্রিন্টার কিমিয়া ইউসুফিকেও কোনো স্বীকৃতি দেয়নি তালিবানরা।
আগামী শনিবার মেয়েদের টাইম ট্রায়ালে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন ইয়ুলদুজ। এছাড়া ৪ আগস্ট বিখ্যাত আইফেল টাওয়ারের সামনে থেকে বিশ্বের সেরা সাইক্লিস্টদের সঙ্গে ১৫৮ কিলোমিটারের রোড রেস শুরু করবেন হাশিমি বোনেরা।
যেভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করলেন ইয়ুলদুজ ও ফারিবা
তুর্কমেনিস্তান সীমান্ত-ঘেঁষা আফগানিস্তানের খুবই রক্ষণশীল ফারিয়াব প্রদেশেই বেড়ে ওঠেন ইয়ুলদুজ ও ফারিবা। একদা স্থানীয় সাইক্লিং প্রতিযোগিতায় নাম লেখানোর সিদ্ধান্ত নিলেন দুই বোন। কিন্তু সাইকেল কীভাবে চালাতে হয় তখনো জানতেন না তারা। তাই শেখার জন্য ধার করে আনেন সাইকেল। বাবা-মা সমর্থন দেবে না ভেবে রেসের ব্যাপারটি গোপনই রাখেন তারা। কিন্তু দ্রুতই সে ভুল ভেঙে যায় তাদের।
মেনে না নেওয়া তো দূরের কথা ডাক্তার বাবা ও গৃহিণী মা হাশিমি বোনদের পূর্ণ সমর্থন দেন। যদিও প্রতিবেশীরা ব্যাপারটি তেমন ভালো চোখে নেননি। তাই বিকেলের সময় অনুশীলন করতেন ইয়ুলদুজ ও ফারিবা, যখন রাস্তায় লোকের আনাগোনা কম ছিল।
আনকোরা হয়েও রেসে প্রথম ও দ্বিতীয় হয়ে চমকে দেন হাশিমি বোনরা। ফারিবা বলেন, ‘ফারিয়াবে কেউ কখনোই ভাবেনি মেয়েরাও সাইকেল চালাবে। আমরা ভেবেছিলাম এটা হয়তো ছোট প্রতিযোগিতা কিন্তু তা কিছুটা আলোড়ন সৃষ্টি করে। ‘
ইয়ুলদুজ বলেন, ‘প্রথমবার যখন সাইকেল চালাই, তখন স্বাধীনতার সুবাস অনুভব করি। কয়েকজন বলেছিল সাইক্লিং মেয়েদের জন্য উপযুক্ত নয় এবং মেয়েদের অনৈতিক কাজে উৎসাহিত করার অভিযোগ দেওয়া হয় আমাদের ওপর। তাই ভয় পেয়েছিলাম, হয়তো খারাপ কিছু ঘটতে পারে আমাদের সঙ্গে এবং কেউ আমাদের ক্ষতি করতে পারে। ‘
এবং এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন ইয়ুলদুজ। অনুশীলনের সময় এক রিকশাচালক ধাক্কা দিয়ে তার কবজি ভেঙে দেয়। আরেকবার যখন ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে অনুশীলন করছিল। তখন দুই বোনকে লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ে মারার পাশাপাশি গালাগালি করেন দর্শকরা।
প্রতিকূল পথ পাড়ি দিয়ে ২০২০ সালে আফগানিস্তানের জাতীয় সাইক্লিং দল থেকে ডাক পান হাশিমি বোনরা। কিন্তু তালিবানরা দেশের দখল নেওয়ার নারী সাইক্লিস্টদের নিরাপত্তার ভয় আরও বেড়ে যায়। ইয়ুলদুজ তখন বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন আর ফারিবা ছিলেন চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়ার আশায়।
কাবুল পতন হওয়ার পর সাবেক ইতালিয়ান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন সাইক্লিস্ট আলেসান্দ্রা কাপ্পেল্লোত্তোর সহায়তায়ে দেশ ছাড়েন হাশিমি বোনেরা। তালিবানের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে থিতু হন উত্তর ইতালিতে। লিটল দোলোমাইতসের আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় ফের অনুশীলন শুরু করেন তারা। ভাষা শিক্ষা থেকে শুরু করে তাদের জন্য সবকিছুর বন্দোবস্ত করেন কাপ্পেল্লোত্তো। ইতালিয়ান সাইক্লিং দলের সঙ্গে তাদের যোগাযোগও করিয়ে দেন তিনি।
২০২২ সালে সুইজারল্যান্ডে আফগানিস্তানের মেয়েদের জন্য রোড চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতা আয়োজন করে সাইক্লিংয়ে সর্বোচ্চ সংস্থা ইউসিআই। ৫০ আফগানের সেই প্রতিযোগিতায় ইয়ুলদুজকে ছাপিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন ফারিবা। এরপর দুই বোনকে বিশ্ব সাইক্লিং সেন্টারের নারী দলে অন্তর্ভুক্ত করে ইউসিআই।
এবার অলিম্পিক মাতানোর অপেক্ষায় আছেন হাশিমি বোনেরা। তাদের উৎসাহ দিতে প্যারিসে থাকবেন কাপ্পেল্লোত্তো। সাবেক এই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বলেন, ‘তারা খুবই শক্তিশালী। অসাধারণ উন্নতি করেছে তারা। দুই বছরে তারা যা শিখেছে, সেটা শিখতে ইউরোপিয়ান মেয়েদের ১০ বছর লাগে। ‘ তাই কাপ্পেল্লোত্তো আশা করে একদিন তারা ট্যুর ডি ফ্রান্সও জিতবে।
অলিম্পিকে সুযোগ পেয়ে স্বদেশিদের কাছ থেকে প্রচুর উৎসাহ পাচ্ছেন হাশিমি বোনেরা। তাদের খেলা তালিবান নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম প্রচার করবে কি না, তা নিয়ে তারা সন্দিহান। তবে আশা করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবাদে হয়তো হাইলাইটস দেখার সুযোগ পাবে তাদের পরিবার ও বন্ধুরা।
ফারিবা বলেন, ‘তারা আমাকে বলেছে- যাও, আফগানিস্তানের পতাকাকে বিজয়ী করে তোলো। মেয়েদের মধ্যে হয়তো আমি ও আমার বোন অলিম্পিকে যাচ্ছি, কিন্তু আমি আশা করি, বাকি আফগান মেয়েদের জন্য পথ খুলে দেব আমরা। ‘
প্রথম সাইক্লিস্ট হিসেবে অলিম্পিকে আফগানিস্তানকে প্রতিনিধিত্ব করলেও হাশিমি বোনেরা অলিম্পিকে খেলা প্রথম আফগান নারী সাইক্লিস্ট মাসুমাহ আলী জাদা। সবশেষ টোকিও অলিম্পিকে শরণার্থী দলের হয়ে খেলেন তিনি। এবারের আসরে শরণার্থী দলের নেতার ভূমিকায় থাকলেও রেস করবেন না।
তবে হাশিমি বোনদের সঙ্গে রেস করার অভিজ্ঞতা আছে আলী জাদার। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই তাদের নিয়ে খুব গর্বিত। তারা আফগান নারীদের প্রতিনিধিত্ব করছে। ইতোমধ্যেই তারা বিজয়ী। ‘
প্রতিকূল অবস্থায় থেকে বেড়ে ওঠা হাশিমি বোনদের কাছে অলিম্পিকে অংশ নেওয়াটাই পদক জয়ের থেকেও বড় কিছু!