• শিল্প-সাহিত্য

    কুকুর হতে সাবধান থাকলাম, কামড় খেলাম মানুষের: ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

      প্রতিনিধি ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ , ১০:১০:২৩ প্রিন্ট সংস্করণ

    চট্টবাণী: জীবনের অনেক কিছু আমরা হারালে ফিরে পাই কিন্তু সময় হারিয়ে গেলে আর ফিরে আসে না। কোন কিছু হারিয়ে গেলে আমরা ইন্নালিল্লাহ পড়ি, জীবন হতে একটি একটি দিন হারিয়ে যাচ্ছে, আমরা ইন্নালিল্লাহ পড়ি না। সময়ের মূল্য অনুধাবন করি না। সবকিছুর মূল্য বুঝি, সময়ের মূল্য বুঝতে পারি না। যৌবন কালের মূল্যবান সময় কাজে লাগাতে পাড়লে জীবন সার্থক হয়। যৌবন কালের ইবাদত মহান আল্লাহ পাকের নিকট অত্যন্ত মূল্যবান। হযরত জিব্রাঈল (আ.) বলেছেন, পৃথিবীতে বৃষ্টি হলে, বৃষ্টির ফোঁটাগুণে আমি শেষ করতে পারি কিন্তু যৌবন কালের ইবাদতের পুণ্য আমি গুণে শেষ করতে পারি না।

    সবাই জীবনযাপন করে,জীবন উদযাপন করতে পারে না। জীবন উদযাপন করার মন্ত্র জানতে হয়। যারা সময়কে কাজে লাগাতে পারে তারা জীবন উদযাপন করার ক্ষমতা রাখেন। কোন সফল মানুষের জীবন সরল পথে চলেনি। ব্যর্থতার পথ ধরে সফলতার জন্ম হয়। কখনো কখনো খারাপ সময় জীবনের সেরা সময়ের পথ তৈরি করে। কোন কাজটি কখন করতে হবে, কোন কাজটি আগে আর কোন কাজটি পরে করতে হবে তা জানার নাম ‘টাইম ম্যানেজমেন্ট’। যে ব্যক্তি ‘টাইম ম্যানেজমেন্ট’ জানে সে সফল মানুষ। সম্পদের জন্য জীবনের ম্যারাথন দৌড়ের নাম সফলতা নয়। সফল হতে হলে সন্তানের জন্য অঢেল সম্পদ জমা না করে সন্তানকে সম্পদে পরিণত করুন।

    সময় চলমান। ঘড়ির কাঁটা জোর করে বন্ধ করলে ঘড়ি বিকল হয়ে যায়, সময় থেমে থাকে না। চলমান সময়ে বর্তমানটাকে কাজে লাগাতে হয়। কারণ আগামীতে কী আছে, কী হবে তা আমরা জানিনা। জীবনটা একটা অজানা বইয়ের মত। পরের পৃষ্ঠায় কী আছে তা আমরা জানি না। ‘লাইফ ইজ এ ইকো’ জীবন হলো প্রতিধ্বনী। জীবনকে তুমি যা দিবে জীবন তোমাকে তা ফিরিয়ে দিবে।

    যুগ ও সময়ের পরিবর্তন হয়। সাহিত্য সংস্কৃতি রাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন-বিবর্তন হয়। অন্ধকারে নিমজ্জিত সমাজে মহামানবের জন্ম হয়। বর্তমান দুনিয়াব্যাপী পরিবর্তনের যুগে প্রকৃত আলোর সন্ধান পাওয়া কঠিন। বাইরের আলো বাড়ছে। ভিতরটা অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে। তিন মনীষীর তিনটি সাড়াজানো কথা বর্তমান সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
    (১) হযরত মাওলা আলী (আ.) বলেছেন, ‘কখন বুঝবে একটি দেশ জাতি ও সমাজ নষ্ট হয়ে গেছে, যখন দেখবে দরিদ্ররা অধৈর্য হয়ে গেছে, ধনীরা কৃপন হয়ে গেছে, মূর্খরা মঞ্চে বসে আছে, জ্ঞানীরা পালিয়ে যাচ্ছে এবং শাসকরা মিথ্যা কথা বলছে।

    (২) সক্রেটিস বলেছেন, ‘এমন একটা সময় আসবে যখন, জ্ঞানীরা জ্ঞানী হওয়ার কারণে অনুশোচনা করবে, মূর্খরা তাদের মূর্খতার জন্য গর্ব করবে আর দুর্নীতিবাজরা তাদের দুর্নীতির জন্য উল্লাস করবে।
    (৩) ঈমাম গাযযালী (রাহ:) বলেছেন, ‘যখন দেখবে শিক্ষক আর চিকিৎসক অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে, তখন ধরে নিবে সমাজ অধঃপতনের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেছে।
    পাঠক মহামনীষীর ভবিষ্যদ্বানীর সাথে আমাদের বর্তমান সমাজের সাথে কতটুকু সাদৃশ্য বৈশ্যদৃশ্য ভেবে দেখার দায়িত্ব আপনাদের নিকট ছেড়ে দিলাম। বর্তমানকালে মূর্খরা নয়, শিক্ষিত মানুষরাই সমাজটাকে গিলে খেতে চায়। তাদের খিদে মারাত্মক ভয়ংকর। যারা ছিনিয়ে নিয়ে খায় তাদের কখনো পেট ভরে না। যারা ভাগ করে খায় তারা কখনো ভুখা থাকে না। শিক্ষিত মেধাবী অমানুষদের চরিত্র দেখতে দেখতে তাদের প্রতি আমার ঘৃনা জন্মেছে। এক জরিপে দেখা গেছে, উচ্চ শিক্ষিতের মধ্যে অমানুষ বেশি। শিক্ষিত এবং উপকার ভোগী এই দুই শ্রেণীর মানুষের অপমান অপদস্তের কথা আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না। এসব অপরাধীদের ক্ষমা করা গেলেও তাদের ভুলা যায় না। তারা মানুষরূপী জানোয়ার। কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমদের একটি অসাধারণ কথা আমার জীবনের সাথে মিলে গেছে। তিনি বলেছেন, সারাজীবন কুকুর থেকে সাবধান থাকলাম, আর কামড় খেলাম মানুষের। প্রকৃতপক্ষে এরা মানুষ নয়, অমানুষ।পশুর চেয়ে অধম তারা। উপকারী গাছের (ঔষধী গাছে) ছাল থাকে না। ঔষধী গাছের ছাল সবাই কেটে নিয়ে যায়। উপকারী মানুষের চামড়া মানুষ তুলে নিতে চেষ্টা করে। বাংলাভাষার প্রথম গ্রন্থ চর্যাপদে লেখা আছে, ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’। হরিণের মাংস সুস্বাদু তাই সবাই হরিণ শিকার করতে চায়। সমাজ ব্যবস্থায় এখন গুণই দোষ।শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক বাঙালির চরিত্র জানতেন, বুঝতেন। তাই কোন মানুষকে চাকুরী দিলে, চাকরির নিয়োগ পত্রের সাথে একটি টাকাও দিতেন। টাকা কেন দিতেন তাঁর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলতেন, বাঁশের টাকা। বাঙালি খুবই অকৃতজ্ঞ। উপকারের প্রতিদান অপকারে আদায় করে। তাই আমার পিছনে বাঁশ দিতে টাকা অগ্রীম দিলাম। তারপরও মানুষের কত উপকার করছি কিন্তু বাঁশের টাকাটা দিতে ভুলে গেছি। তারা যতই অপকার করুক আমাদের উপকার করে যেতে হবে। কিন্তু উপকার ভোগী হতে প্রতিদান আশা করা যাবে না। আশা করলে কষ্ট পাবেন। এই কষ্ট মানুষকে অসুখি করবে। মানুষের জন্য যা কবে তা ভুলে যতে হবে। ডিলিট করে দিতে হবে। যাদের উপকার আপনি ভোগ করছেন শুধু তাদের মনে রাখতে হবে। উপকারের প্রতিদান মহান আল্লাহ ইহকাল ও পরকালে দিয়ে থাকেন। যার উপকার করবেন তার হতে প্রতিদান না পেলেও এমন মানুষ আপনার দুঃসময়ে পাশে দাঁড়াবেন, যাদের জন্য আপনি জীবনে কিছুই করেননি। এটি হলো দুনিয়ার প্রতিদান। আর আখিরাতের প্রতিদান হলো জান্নাত।পরোপকারী মানুষ সহজ সরল এবং সুখি হয়। বুদ্ধিমান মানুষ জটিল প্রকৃতির হয়। জটিল মন সুখি নয়। নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বলেছেন, ‘সবচেয়ে দুর্লভ বিষয় হচ্ছে, বুদ্ধিমান মানুষ সুখি হতে দেখা’। মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (র.) বলেছেন, ‘বুদ্ধি বলে বাড়াও প্রেম বলে হারাও’। স্বার্থপর ব্যক্তি মানুষকে ভালোবাসতে পারে না। তারা নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু বুঝতে চায় না। স্বার্থ পূরণের জন্য মানুষ যা হারিয়ে ফেলে তা হলো মনুষ্যত্ব। শরৎচন্দ্র বলেছেন, ‘মানুষের মৃত্যুতে আমি দুঃখ পাই না। মনুষ্যত্বের মৃত্যুতে দুঃখ পাই’। মানুষের জন্ম হয়েছে মৃত্যু বরণ করার জন্য। কিন্তু মানুষ হয়ে দুনিয়াতে জন্ম নিয়ে মনুষ্যত্ব হারানোর মত বেদনাদায়ক আর কিছু নেই। আধুনিক কালে শিক্ষা বিজ্ঞান প্রযুক্তির অনেক কিছু শিখায়,কিন্তু মনুষ্যত্বের শিক্ষার অভাব রয়েছে। বর্তমান শিক্ষার উদ্দেশ্য ধনী হওয়া। সুপারস্টার রজনীতিকান্ত বলেছেন, বড় লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখা অন্যায় নয়, কিন্তু মনে রাখতে হবে তোমার প্রয়োজন যেন লোভে পরিণত না হয়। প্রয়োজন ভিক্ষুকেরও পূর্ণ হয়, লোভ রাজারও অপূর্ণ থাকে।

    লেখক: কলাম লেখক, রাজনীতিক।

    আরও খবর 32

    Sponsered content