চট্টবাণী : সমগ্র পৃথিবীব্যাপী বিজ্ঞান প্রযুক্তি শিক্ষা যোগাযোগসহ সবকিছুর উন্নতি হচ্ছে, হবে, হতেই থাকবে। যদি বড় বিপর্যয়ের কারণে পৃথিবী ধ্বংস না হয়। হাজার হাজার বছরে বিজ্ঞান প্রযুক্তির যত উন্নতি হয়েছে, তার চেয়ে গত ৩০ বছরে বিজ্ঞান প্রযুক্তির উন্নতি ৩০গুণের অধিক হয়েছে। আগামী ৩০ বছর পর বিজ্ঞান প্রযুক্তির উন্নতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা কেউ কল্পনা করতে পারবে না। দুনিয়ার সেরা সেরা মেধাবী ছাত্রদের একত্রে বসিয়ে যদি বলি তোমরা 'ত্রিশ বছর পর বিশ্ব' শিরোনামে একটি রচনা লেখ, তারা তাদের সব মেধাটুক ব্যয় করে যদি এই বিষয়ে একটি রচনা লেখেন সে রচনাটি যদি বক্সবন্দী করে রাখা হয়, রচনাটি টমাস আলভা এডিসনের মায়ের নিকট লেখা স্কুল শিক্ষকের চিঠির মত আরমারি হতে বের করে ৩০ বছর পর যদি পড়েন, তখন দেখবেন পরিবর্তিত বিশ্বের সাথে পৃথিবী নামক গ্রহটির সাথে একদম মিল নেই। দুনিয়ার পরিবর্তন কল্পনার চেয়ে দ্রুত হবে। দুনিয়ার এই পরিবর্তনের জন্য কোন আন্দোলন সংগ্রাম হরতাল মানববন্ধন করতে হবে না। এ সব বাইরের উন্নতি হতে থাকবে। এই উন্নতির যুগে দ্রুত অবনতি হচ্ছে নৈতিকতা ও মনুষ্যত্বের। একটি আন্দোলন এখন প্রয়োজন, পশুত্ব-বিসর্জন আর মনুষ্যত্বের জাগরণের আন্দোলন, এই আন্দোলনের জন্য বড় প্রয়োজন মানুষের বিবেককে জাগিয়ে তোলা। পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ বাড়ছে, মাদ্রাসা বাড়ছে, স্কুল-কলেজ বাড়ছে, শিক্ষার হার বাড়ছে, এ-প্লাস, গোল্ডেন এ-প্লাস বাড়ছে, ওয়াজ-বয়ান বাড়ছে, সবকিছুর উন্নতির কালে মানুষের মনুষ্যত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষের নিকট পশুত্বের শক্তি বৃদ্ধির কারণে,ভোগের বস্তুর আকর্ষণে মানুষ লোভ আর লাভের চিন্তায় উম্মাদ হয়ে পড়ছি।
হযরত মাওলা আলী (রা.) বলেছেন,'নিজকে প্রয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখো, লোভের মধ্যে নয়। প্রয়োজন ভিক্ষুকেরও পূর্ণ হয়, লোভ মহারাজারও পূর্ণ হয় না'।
দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। চিন্তা করতে হবে আমরা দেশকে কতটুকু প্রকৃত ভালবাসি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়। ২ লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমহানি হয়। একাত্তরে তাঁরা কেউ সম্পদের লোভে শহীদ বা আত্মমর্যাদা বিসর্জন দেননি। তাঁদের সবার স্বপ্ন ছিল দেশের সার্বিক মুক্তি। যারা স্বাধীন দেশে দুর্নীতি করবে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করতে পারে না। বৃটিশরা আমাদের গোলাম বানাতে চেয়েছে, পাকিস্তানিরা মুসলমান বানাতে চেষ্টা করেছে, বঙ্গবন্ধু বাঙালি বানাতে চেয়েছেন, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি বানাতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু কেউ আমাদের মানুষ বানাতে পারেনি।
এখন ধনাঢ্য ব্যক্তির অভাব নেই।আগে মানুষ বাস করতো দরিদ্রসীমার নীচে এখন মানুষ বাস করে চরিত্রসীমার নিচে। অঢেল টাকার মালিক হলে বিলাসবহুল হাসপাতালে সন্তান জন্ম দিতে পারবেন। দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করতে পারবেন, উন্নত খাওয়ার খাওয়াতে পারবেন, বিলাসবহুল অট্টালিকায় সন্তানকে লালন পালন করতে পারবেন, বিদেশি দামি ব্রান্ডের পোশাক পরাতে পারবেন, কিন্তু দামি মানুষ গড়তে পারবেন না। দামি মানুষ করতে নীতি নৈতিকতার শিক্ষা দরকার। দিন দিন এই শিক্ষার অভাব প্রকট হচ্ছে। বিকৃত রুচির প্রজন্ম বৃদ্ধি পাচ্ছে। মনীষীদের কথাটি সত্য, 'জন্মদাতা হওয়া সহজ, পিতা হওয়া কঠিন'। পশু পাখিও জন্মদাতা হয়, কিন্তু পিতা হরে পারে না। পিতা হওয়ার দায়িত্ব অনেক বড়। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহের লাল নেহেরুর পিতা মতিলাল নেহেরুর নিকট জানতে চেয়েছিলেন, আপনার জীবনের সফলতা কী? তিনি জানালেন, আমার জীবনের সফলতা হলো, জওহের লাল নেহেরু। জওহের লাল নেহেরুর নিকট জানতে চাইলেন, আপনার জীবনের সফলতা কী? তিনি জানালেন, আমার জীবনের সফলতা হলো, 'ইন্দ্রিরা গান্ধী'। সত্যিকার অর্থে নিজের সন্তানদের মানুষ করতে না পারলে পুরো জীবনের আয়োজন ব্যর্থ হয়ে যায়। সবাই মিলে যদি নিজের সন্তান, যারা আগামীর বাংলাদেশ, তাদের সত্যিকারভাবে নির্মাণ করতে পারলে পুরো দেশটাই এগিয়ে যাবে।এটিই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
আজ আমরা ফেইজবুক আসক্তির জন্য আমাদের সন্তানদের দোষারোপ করি কিন্তু সন্তানদের আমরা সময় দিতে পারি না। সন্তানদের বন্ধু বানাতে পারি না। সবাই ফেইজবুক বন্ধু করে নিচ্ছি। যান্ত্রিক জীবনে আমাদের আন্তরিক খোরাক নষ্ট করে ফেলছি। আমাদের সন্তানরা খেলতে খেলতে খেলোয়াড়, আর জানতে জানতে জানোয়ার হচ্ছে। আমাদের সন্তানদের প্রচুর শিখাচ্ছি, কিন্তু তাদের অভিজ্ঞ করে গড়ে তুলতে পারছি না। শিক্ষা এক বছরে যা শিখায় অভিজ্ঞতা দশ দিনে তার চেয়ে অধিক শিখায়। বর্তমান যুগকে বলা হয় 'ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ে'র যুগ। আমরা তথ্যের মহাসড়কে বাস করে সত্যের সন্ধান পাচ্ছি না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'আমাদের শিক্ষা যেন তথ্য না দেয়,সত্যও দেয়'।তথ্যে যুগে সত্য হারিয়ে যাচ্ছে।
মানুষের একটি সংস্কৃতি আছে, ধর্মের একটা সংস্কৃতি আছে, বাঙালির একটি সংস্কৃতি আছে। আজকের প্রজন্ম কোন সংস্কৃতিই আত্মস্থ করতে, চর্চা করতে চায় না। জীবনের সাথে সংস্কৃতিরএকটি মেলবন্ধন আছে, সংস্কৃতির সাথে জীবনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। জল ছাড়া মাছ বাঁচে না, সংস্কৃতি ছাড়া মানুষের জীবন চলে না। মানুষের আচার আচরণ সংস্কৃতির অংশ। আত্মার মৃত্যু ঘটিয়ে অসুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার নাম অপসংস্কৃতি। কাজী মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলেছেন, 'সুন্দর ভাবে বিচিত্র ভাবে, মহৎ ভাবে বেঁচে থাকার নাম সংস্কৃতি'। এখন তো সুন্দর ভাবে বিচিত্র ভাবে, মহৎভাবে বেঁচে থাকা কঠিন। ব্যাপক দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মাদক, নৈতিকতা বিরোধী অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, নোংরামী, ঠাণ্ডামাথায় পারিবারিক খুন, অন্যায় অবিচারের উৎসবে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা যায় না। এমন একটি সমাজে বসবাস করছি, যে সমাজে এক সময় পাপের ভয়ে মিথ্যা বলতো না, এখন বিপদে পড়ার ভয়ে সত্য বলে না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'আমরা উন্নয়নের পালে ফু দিয়েছি, যত গাল ফুলেছে তত পাল ফুলেনি'। সুন্দর কথা বলি আমরা কাজ করি তার বিপরীত, মানুষকে পরামর্শ দিই কিন্তু উপকার করি না।
সবচেয়ে সহজ কাজ হলো পরামর্শ দেওয়া। একজনের কাছে চাইলে দশজন দিবে। আর সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো মানুষকে সাহায্য করা। দশ জনের কাছে চাইলে একজনের নিকট সাহায্য পাওয়া কঠিন। বাঙালি এত বেশি কথা বলে তার জন্য এক সময় বলা হতো মুখের উপর টেক্স বসালে বাঙালির কথা কমতো। দেখা গেল মোবাইলের উপর টেক্স বাড়িয়েও বাঙালির কথা কমাতে পারেনি। উন্নত-অনুন্নত কোন দেশের মানুষ মোবাইল ফোনে এত বেশি বলে না। পশ্চিমা সংস্কৃতি আমাদের পরিবার ছোট করে দিচ্ছে কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের নেট যোগাযোগ হতে পরস্পরকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। ধন থাকলে ধনী হয় না, বড় মন থাকলে সে-ই বড় ধনী। আপনি কতটা ধনী তা নির্ধারিত হয়, তোমার কাছে এমন কিছু রয়েছে যা অর্থ দিয়ে কেনা যায় না। নৈতিক মানুষের নিকট এমন কিছু থাকে যা অঢেল অর্থ বিত্ত দিয়ে কেনা যায় না।
আজ অর্থবিত্তে ধনীর অভাব নেই। প্রকৃত মনুষ্যত্বের ধনী এক প্রজন্ম সৃষ্টি করতে হবে। তরুণদের সামনে যদি কোন আদর্শ তুলে ধরলে সক্ষম না হই তাহলে তারা জঙ্গি, সন্ত্রাসী, টেন্ডারবাজ, মাদকাসক্ত হতে বাধ্য। র্যাব, পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে তরুণদের চরিত্র সংশোধন করা সম্ভব নয়। আজকের প্রজন্মের ভাষা আমরা বুঝতে পারছি না। ঐশি নামক কিশোরী আজ বাবা-মাকে মাদকের টাকার জন্য হত্যা করে। আমরা কোথায় যাচ্ছি, সভ্যতার দিকে, না আইয়ামে জাহিলিয়াতের দিকে? প্রজন্মের নিকট আদর্শ কী, এই প্রজন্ম কী হতে চায়? এক জরিপে দেখা গেছে আমাদের শিশু-কিশোররা এখন ফুটবল তারকা, ক্রিকেট তারকা, সিনেমার নায়ক, বিল গেটস, স্টিভ জবস হাতে চায়, কেউ সেক্সপিয়র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল-আইনস্টাইন হতে চায় না। অর্থ বিত্তের জন্য ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তার হতে চায় কিন্তু মাদার তেরেসা হতে চায় না। আত্মকেন্দ্রিক মানুষের সংখ্যা কমিয়ে উদার পরোপকারী মানুষের সংখ্যা বাড়াতে না পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ডুবে যাবে।
লেখক: কলাম লেখক, রাজনীতিক।