চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: রাষ্ট্র সংস্কার ও মেরামতের মাধ্যমে নতুন এক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে চট্টগ্রামে আয়োজিত হয়েছে ‘বৈষম্যহীন রাষ্ট্রভাবনা’ নাগরিক সংলাপ। এতে ছাত্র-শিক্ষক, রাজনীতিবিদ ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধি এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করা উপস্থিত ছিলেন।
শনিবার (১৭ আগস্ট) দুপুর ৩টায় চট্টগ্রামে জিইসির একটি রেস্টুরেন্টে সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তা কেন্দ্রের (সিএসপিটি) উদ্যোগে এ নাগরিক সংলাপের আয়োজন করা হয়েছে।
এসময় বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যকর ভূমিকায় করণীয়, দেশের অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়াসহ জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে বিরাজনীতিকরণ করে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে মতামত নেওয়া হয়।
সিএসপিটি’র পরিচালক অধ্যাপক ড. এনায়েত উল্যা পাটওয়ারীর সভাপতিত্বে প্যানেল আলোচক হিসেবে ছিলেন চবি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সাইফুল ইসলাম, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন, মার্কেটিং বিভাগের ড. মো. ফুয়াদ হাসান, চবি লোকপ্রশাসন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মমতাজ উদ্দিন, প্রাণরসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রেজওয়ানুল হক এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শহীদুল হক। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ, লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. আমীর মুহাম্মদ নসরুল্লাহ, দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মোজাম্মেল হক এবং বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও শিক্ষার্থীরা এতে বক্তব্য রাখেন।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ বলেন, দেশের সকল স্থান থেকে দুর্নীতি রোধ করতে পারলেই আমরা একটি সুন্দর দেশ গড়ে তুলতে পারবো। বাংলাদেশের সব দল, মতের সকলকে আহ্বান করবো আপনারা দেশ সংস্কার করার জন্য যে সময়টুকু প্রয়োজন তা আমাদের এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দিবেন। সংস্কারের কাজ শেষ হলেই সরকার গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন দিবেন।
সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি বলেন, আমাদের সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো বৈষম্যবিহীন একটি রাষ্ট্র গঠন করা। দেশের প্রতিটি জায়গার বৈষম্য দূর না হওয়া পর্যন্ত ছাত্র-জনতার এ লড়াই চলবে।
চবি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা উন্নয়নের অনেক গালগল্প করেছি। মানবাধিকারের গুরুত্ব দেয়নি। নামে-বেনামে অনেক সরকার দেখেছি। কিন্তু বৈষম্য দূর করতে পারিনি। সরকার জনগনের টাকায় চলা সরকারি সংস্থাগুলোকে ন্যাক্কারজনকভাবে ব্যবহার করেছে নাগরিকদের বিরুদ্ধেই। ২০০৯ সালের পর থেকে যে হারে বিচারবহির্ভূত গুম ও খুন হয়েছে তা অবর্ণনীয়। সরকার র্যাবকে দিয়ে এসকল কাজ করেছে। র্যাব নিয়ে আলোচনা শুরু হলে পুলিশ ও বিজিবি দিয়ে এসকল গুম খুন জারি রাখা হয়। আওয়ামী সরকারের আমলে গুম শুরু হয়েছে। বস্তাবেঁধে নদীতে ফেলে দেওয়া হতো। এ সংস্কৃতি আমরা তৈরি করেছি। তাদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য আমাদের করের টাকা ব্যবহার করেছে। আমাদের গণতন্ত্রকে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। আমরা দেখেছি কিভাবে আবু সাইদকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা অধিকার আদয়ের জন্য ৩ বার স্বাধীন হয়েছি৷ ২৪ এর স্বাধীনতা হচ্ছে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার স্বাধীনতা৷ এই রাষ্ট্রের বৈষম্য দূর করতে হলে সবার আগে মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
চবির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, যদি অর্থনীতির সংকটের কথা বলি তাহলে আমাদের এ সংকট উত্তরণের জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। আমরা বাজারে গেলে বুঝতে পারি অর্থনীতির কি অবস্থা। মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিট অতিক্রম করেছে। এর মূল ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষজন। স্বৈরাচারী হাসিনার পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। বাড়ি পুড়ে যাওযার পর ৫ কোটি টাকা পাওয়া যায়। দেশ চরম একটি অর্থনৈতিক সংকটে আছে।
অধ্যাপক রিজওয়ানুল হক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল নিয়োগগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ চালু নেই। মানসম্মত স্কেল চালু করলে বাইরে পড়াশোনা করা অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক আনা সম্ভব। আমাদের মানসম্মত শিক্ষকের অভাব। তাদের বেতন অনেক কম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোনো স্টাফ নেই। শহরের প্রাইমারি স্কুলগুলোতে নিম্নবিত্তদের জন্য ব্যবস্থা নেই। যেসকল শিক্ষকদের মোটিভেশন নেই, তারা শিক্ষার্থীদের ভালো শিক্ষা দিতে পারবে না। ল্যাব সুবিধা, নিয়মিত বিজ্ঞান মেলা ইত্যাদি ক্যারিকুলাম করতে হবে। কলেজে ইন্টারমিডিয়েটটা ভালোভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধান সমস্যা হলো নিয়োগ। এখানে মানসম্মত শিক্ষক নেই৷ পিএইচডিধারী শিক্ষক কম। যারা বাহিরে আছে তাদের একটি ভালো বেতনের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। গবেষণায় বাজেট কম। ভালো গবেষকদের দেশে আনতে হবে। জবরদস্তি একটি ক্যারিকুলাম আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছিলো। এই ক্যারিকুলাম বাদ দিতে হবে।
চবির যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শহীদুল হক বলেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার রন্দ্রে রন্দ্রে সমস্যা। ১১-১২ বছরে যৌনশিক্ষার অবাধ জানাশুনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিবর্তনবাদ, ট্রান্সজেন্ডার, এখানে সংযোজন করা হয়। এছাড়া ধর্ম শিক্ষাকে উপেক্ষা করা হয়েছে সবসময়। প্রস্তাবনা, কলাম, বক্তৃতার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি তুলে ধরতে হবে। দেশের বৈশ্বিক শক্তির প্রভাব যাতে বৃদ্ধি না পায় সে বিষয়ে নিয়মিত লেখালেখি করতে হবে। নতুন কারিকুলামের ত্রুটিগুলো বিভিন্নভাবে সরকারের কাছে তুলে ধরতে হবে৷
সরকার অফিস ও নাগরিক সেবা নিয়ে লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারি সেবা প্রধানকারীদের তালিকা দৃশ্যমান করা উচিৎ সকল ডাটাসহ। সকল বিষয় বাইরে ঝুলানো থাকবে। সরকারি কার্যালয়ে ইলেকট্রনিক ওয়েটিং টোকেন ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে কাউকে আগে বা পরে না করা হয়। এছাড়া নাগরিক সেবা সহজকরণ। সবকিছুই ডিজিটাল করার পর জটিলতা তৈরি হচ্ছে। ইনক্লুসিভ ও মানবিক ট্রেনিং নিশ্চিত করা সকল সরকারি কমকর্তাদের। দালাল দূর করতে হবে সকল সরকারি অফিস থেকে।
অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ বলেন, আগস্ট বিপ্লবের নায়ক যেমন ছাত্ররা তেমন আমরাও৷ বিপ্লব এখনো শেষ হয়নি। আমাদেরকে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে, নইলে তারা আবার আমাদের উপর চেপে বসবে। এ বিপ্লবের নায়ক দেশের সকল মানুষ। আমাদের সংবিধান এবং নিয়মের মধ্যে থেকে সকল কাজ করতে হবে। বৈষম্য তৈরি হয় নিজের যোগ্যতার কারণে। আর যখন রাষ্ট্রে বৈষম্য তৈরি হয় তখনই, যখন রাষ্ট্রের কার্যালয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা বৈষম্য তৈরি করে। সরকার নিজেকে নিজের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা এমন করে দাড় করাতে হবে যাতে সবাই দায়িত্ব নিতে ভয় পায়। সরকারি মন্ত্রীকে দেশের তৈরি যানবাহন এবং রিকশা ভ্যানে যাতায়াত করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক ড. এনায়েত উল্যা পাটওয়ারী বলেন, নিজের নেতাদের কাছ থেকে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে সব নাগরিকের এবং এটাও জনগণের মৌলিক অধিকার। কোরিয়ায় এক প্রবাদ আছে, "তোমার হাতে যতগুলোই সুন্দর মুক্তা থাকুক না কেন, এগুলো যদি একসঙ্গে একই সুতোয় না গাঁথো, তাহলে কখনোই একটা সুন্দর গলার হার বানাতে পারবে না"। আমাদের দেশের কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা একাকী কোনো দলের বা গোষ্ঠীর পক্ষে সম্ভব না। এ জন্য সকলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। যারা একসঙ্গে কাজ করবে তাদের সামনেই রয়েছে সুন্দর ভবিষ্যৎ।