সোহাগ ফরহাদ: কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের ল্যাব টেস্টের টাকা ডাক্তার-নার্সদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারার অভিযোগ উঠেছে। দীর্ঘ ৩ বছর ধরে আই.সি.ইউ ইনচার্জ ডাক্তার কফিল উদ্দিন আব্বাসের নেতৃত্বে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা।
জেলার একমাত্র সরকারী হাসপাতালে সরকারী ভাবে পরিচালনায় আইসিইউ এর ল্যাবে ৩০ টিরও বেশি টেস্ট করা হয়। রোগ নির্ণয় করতে এসব টেস্টের সমস্ত টাকা যাচ্ছে ডাক্তার-নার্সদের পকেটে। সরকারী হাসপাতালে ভেতরে যেন বেসরকারী হাসপাতাল গড়েছেন তাঁরা। কক্সবাজার সদর হাসপাতালের সরকারী হাসপাতালের ল্যাবটি ব্যক্তিগত বলে চালিয়ে যাচ্ছেন বেসরকারী নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসকরা।
তাদের দাবী, সরকারী খরচে রোগ নির্ণয়ের সরঞ্জাম শেষ হওয়ায়, তারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে সরঞ্জাম কিনে টেস্ট গুলো করাচ্ছে। সরকারী ভাবে হেপাটাইটিস বি, সি ও কয়েকটি পরীক্ষা ব্লাড ব্যাংকেই বিনা মূল্যে করা হয়। অথচ আইসিইউতে ভর্তি থাকা রোগীদের থেকে নেয়া হচ্ছে ৪৫০ টাকা করে। আর এবিজি (আর্টারিয়াল ব্লাড গ্যাস এনালাইসিস) টেস্টে নেয়া হচ্ছে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। কক্সবাজার সদর হাসপাতালে সরেজমিনে অনুসন্ধান করে ভয়ঙ্কর তথ্য মিলেছে।
ইতিমধ্যে সদরের আইসিইউ বিভাগে কর্মরত এনজিও চিকিৎসক ডাক্তার মোসাব্বির হোসেন তানিমকে ইউনিয়ন হাসপাতালে কর্মরত ও চিকিৎসা দেয়ার দায়ে চাকরীচূত করেছে এনজিও সংস্থা আইএমও। চাকরী যাওয়ার এক মাসের মাথায়, চলতি মাসের নভেম্বরের ১ তারিখ থেকে বিনা বেতনে আবারো আইসিইউতে যুক্ত হয়েছেন ডাক্তার মোসাব্বির হোসেন তানিম। এ যেন স্বর্ণ ডিমের হাস! সদর হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগ যেন চিকিৎসক নার্সদের টাকা কামানোর মেশিনে পরিণত হয়েছে।
শুধু তাই নয়, অভিযোগ মতে- আইসিইউ বিভাগে কর্মরত ডাক্তার ইব্রাহিম খলিল নামে এক চিকিৎসক, তার গ্রামের বাড়িতে একটি ডায়াগনিষ্টিক সেন্টারে সময় দিতে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে রিজাইন লেটার জমা দিয়েছেন। তবে সেই রিজাইন লেটার গ্রহণ না করে, বরং সেই ডিউটি ডাক্তার মোসাব্বির হোসেন তানিম করে দিবে বলে, ডাক্তার মুসাব্বির হোসেন তানিমকে আবারো দায়িত্ব দেয়া হয়েছে গোপনে অন্যায়ভাবে। তবে ডাক্তার ইব্রাহিম খলিল নামে এই চিকিৎসক মাসে আসবে শুধু ৪ দিন। ওই ৪ দিনেই রোস্টার গুলো তৈরি করে দিয়ে আবারো বিমানযোগে চলে যাবেন। তার বেতনের একটি অংশ পাবে ডাক্তার মোসাব্বির হোসেন তানিম।
সূত্রমতে, ভয়াবহ করোনার মাঝে ২০২০ সালের ২০ জুন কক্সবাজার সদর হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের আন্তরিক প্রচেষ্টা, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর, স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্থা ডবিøউ এইচ ও চিঠি চালাচালির পর ১০ শয্যার আই সি ইউ ও ৮ শয্যা বিশিষ্ট এইচ ডি ইউ চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম হয়। সেই থেকে আইসিইউতে চিকিৎসা নেয়া রোগীদের রোগ নির্ণয়ের জন্য বেশ কয়েকটি সরঞ্জাম নিয়ে একটি ল্যাব সৃষ্টি হয়। এই ল্যাবের সমস্ত সরঞ্জাম দেয় ডব্লিউ এইচও।
২০২১ সালের ২০ জুন শিল্পী তাহসানকে দিয়ে ল্যাবটি উদ্বোধনের পর থেকে রোগীদের বিনা মূল্যে টেস্ট করা হতো সেখানে। কিছুদিন পর টেস্ট করার কিট ফুরিয়ে গেলে বন্ধ হয়ে যায় ল্যাবটি। ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে সদর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে না জানিয়ে ল্যাবটি আবারো চালুর দায়িত্ব নেন আইসিইউ প্রধান ডাক্তার কফিল উদ্দিন আব্বাস। বেসরকারী কোম্পানী থেকে বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ের মেশিন মজুদ করেন তিনি। আইসিইউ বিভাগটি সম্পূর্ণ এনজিওর হলেও পরিচালনার দায়িত্ব সম্পূর্ণ সরকারী। অথচ ডাক্তার কফিল উদ্দিন আব্বাস, ডাক্তার মোসাব্বির হোসেন তানিম ও ডাক্তার ইব্রাহিম খলিল তারা নিজেদের সম্পত্তির মতো চালিয়ে আসছেন চিকিৎসাখাতের গুরুত্বপূর্ণ এই আইসিইউ বিভাগ। এখানে কয়েকজন চিকিৎসক আর ২৬ জন নার্স দিয়ে চলে আইসিইউ বিভাগ।
তবে মজার ব্যাপার হলো- আই সি ইউ এর ইনচার্জ ডাক্তার কফিল উদ্দিন আব্বাস, বেসরকারী নিয়োগ পাওয়া ডাক্তার মোসাব্বির হোসেন তানিম, ও ডাক্তার ইব্রাহিম খলিল ছাড়াও, ল্যাবের মোটা টাকার একটি অংশের ভাগ পান ডাক্তারদের পছন্দনীয় ৮ জন সিনিয়রর স্টাফ নার্স। সেই নার্সদের দায়িত্বে আছেন নার্স ইনচার্জ প্রিয়াংকা দাশ।
নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, কোন রোগী আই সি ইউ বিভাগে আসলে, রোগ নির্ণয় করতে শুধু মাত্র সিলেক্ট করা ৮ জন সিনিয়র স্টাফ নার্সই টেস্ট করতে পারবে। বিনিময়ে প্রতিজন নার্স মাসে ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা করে ভাগ পান। আর ওই ৮ জন নার্সের মধ্যে ২ জন কে কক্সবাজারের বেসরকারী ইউনিয়ন হাসপাতালে চাকরী করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন, আই সি ইউ ইন্চার্জ- ডাক্তার কফিল উদ্দিন আব্বাস ও নার্স ইনচার্জ- প্রিয়াংকা দাশ।
সদর হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন হাসপাতালের ৬ তলার আই সি ইউ ও ডায়ালাইসিস বিভাগে যে দুই জন নার্স চাকরী করেন, তারা হলেন- তামান্না ইয়াসমিন ও তাসলিমা খাতুন (ইউনিয়ন হাসপাতালে কর্মরত ভিডিও সংরক্ষন আছে, এই প্রতিবেদকের হাতে)।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আই সি ইউ বিভাগের ল্যাব থেকে টাকার ভাগ পাওয়া নার্সরা হলেন- ১.তামান্না ইয়াসমিন, ২.তাসলিমা খাতুন, ৩.শুভেচ্ছা আক্তার, ৪.আফসানা খাতুন, ৫. আফসানা মিমি, ৬. শরবানু, ৭.নিলুফা খাতুন ও ৮.সুফিয়া খাতুন।
জেলা সদর হাসপাতাল ও কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়োজিত এই ৮ জন সিনিয়র স্টাফ নার্স দিয়ে এবিজি পরীক্ষাগুলো করানো হয়। আর অন্যান্য টেস্ট করতে দায়িত্বে আছেন, ল্যাব টেকনিশিয়ান- সাঈফুদ্দিন খালেদ। আই সি ইউ তে কোনো রোগী আসলেই খালেদকে দিয়ে টেস্ট গুলো করানো হয়। সদর হাসপাতালের আই সি ইউ ভবনে ৪ তলায় এই ল্যাবটি যে সচল আছে, এটি অনেকেই জানেন না। তবে হাসপাতালটির একজন আরএমও জানলেও, তাকে ম্যানেজ করে নেন আই সি ইউ ইনচার্জ কফিল উদ্দিন আব্বাস।
সূত্রমতে, চিকিৎসা বিজ্ঞানে রোগী বাঁচানোর শেষ আশ্রয় হলো- আই সি ইউ (নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র)। সেই আই সি ইউ এখন চিকিৎসক-নার্সদের বানিজ্যে পরিনত হয়েছে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে। জেলা সদরের একমাত্র সরকারী চিকিৎসা কেন্দ্র হলেও, এখন টাকা কামানোর মেশিন আই সি ইউ বিভাগ।
দেশের একমাত্র উন্নত জেলা সদর হাসপাতাল হিসেবে নাম রয়েছে- কক্সবাজার সদর হাসপাতালের। এখানেও যে দূর্নীতি হয় না, তা কিন্তু নয়। চিকিৎসা কার্যক্রমে আই সি ইউ ডিপার্টমেন্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থান থেকে নার্সদের বেসরকারী হাসপাতালে চাকরীর সুযোগ করে দেয়া, এটা মারাত্বক অন্যায়। তবে নার্সিং সুপারভাইজররা বিষয়টি জানলেও, না জানার অভিনয় করে বসে থাকেন বলে, মন্তব্য করেছেন- কয়েকজন সচেতন নার্স।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক সদর হাসপাতালে নিয়োজিত অসংখ্য নার্সদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কিছু নার্সকে সরকারি হাসপাতালে চাকরির পাশাপাশি বেসরকারী হাসপাতালে চাকরী করতে সুযোগ দিয়ে থাকেন, কিছু ডাক্তার আর কিছু নার্স ইনচার্জ। যেমন-আই সি ইউ নার্স ইনচার্জ প্রিয়াংকা দাস। বেসরকারী ইউনিয়ন হাসপাতালে যারা চাকরী করে, তাদের ডিউটি রোস্টারের ক্ষেত্রে সব সময় ইউনিয়ন হাসপাতালের রোস্টারের অপোজিট ভাবে রোস্টার তৈরী করে দিয়ে, তাদেরকে ইউনিয়ন হাসপাতালে নিয়মিত চাকরি চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ/সুবিধা তৈরী করে দিয়ে থাকে। যার ফলে বাকি নার্সদের চাপাচাপি করে ডিউটি ভাগ করে দিয়ে থাকে। আর কখনো জরুরী প্রয়োজনে হলেও, বাকি নার্সরা যথা সময়ে ছুটি কিংবা একটু সুযোগ পাননা।
তামান্না ইয়াসমিন ও তাসলিমা খাতুন সরকারি জবে জয়নিংয়ের প্রথম অবস্থা থেকে এখন পর্যন্ত (দীর্ঘ ২ বছর যাবত) সদর হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী বেসরকারী হাসপাতালে চাকরী করছেন। অথচ সিনিয়রদের অনেকেই বিষয়টি জানেন, কিন্তু বিষয়টি তারা এড়িয়ে যাচ্ছেন।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক সদর হাসপাতালের কর্মরত কয়েকজন নার্স বলছেন-ইউনিয়ন হাসপাতালের ডায়ালাইসিস ও আই সি ইউ বিভাগে যে সকল নার্স চাকরী করে, তাদের ডিউটি রোস্টারটি পাঠিয়ে দেন সদর হাসপাতালের আই সি ইউ ইনচার্জ ডাক্তার কফিল উদ্দিন আব্বাস ও নার্স ইনচার্জ প্রিয়াংকা দাশের কাছে। ফলে ডাক্তার কফিল উদ্দিন আব্বাসের দিক নির্দেশনায় নার্সিং ইনচার্জ প্রিয়াঙ্কা দাশ, যারা বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করে, তাদেরকে সুযোগ- সুবিধা দিতে গিয়ে, সদর হাসপাতালের আই সি ইউ তে কর্মরত বাকি নার্সদের রোস্টার গুলো সর্বদা নিয়মের বহির্ভূত ভাবে তৈরী করে থাকে। তবে এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ সত্য নয় বলে দাবী করেছেন আইসিইউ ইনচার্জ ডা. কফিল উদ্দিন আব্বাস।
বৃহস্পতিবার (৯ নভেম্বর) বেলা ১২ টায় সদর হাসপাতালে কথা হয় এই প্রতিবেদকের সাথে। তিনি বলছেন, এসব বিষয় হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধয়াক ডা. মমিনুর রহমানকে অবগত করেই আইসিইউ বিভাগে রোগীর সুবিধার্থে পরীক্ষাগুলো করা হয়। ৩০ টি পরীক্ষা সেখানে হয় না, কিছু পরীক্ষা হয় বলে স্বিকার করেছেন ডা. কফিল উদ্দিন আব্বাস। তবে তাঁর সিলেক্ট করা ৮ জন নার্স দিয়ে ব্লাড কালেকশন এবং এবিজি পরীক্ষার বিষয়ে তিনি বলছেন যারা সবচেয়ে এক্সপার্ট তাদের দিয়ে পরীক্ষাগুলো করা হয়।
ডা. খলিলের বিষয়ে তিনি বলছেন প্রতি মাসে সম্পূর্ণ ১২দিন ডিউটি করেন তিনি আর ডা. মোসাব্বির হোসেন তানিমের তার বেতন থেকে একটি অংশ পান এটাও সত্য নয় বলে দাবী করেন আইসিইউ ইনচার্জ কফিল উদ্দিন।
এদিকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধয়াক ডা. মং টিং ঞো বলছেন, সদর হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের ল্যাব থেকে টাকা উত্তোলনে বিষয়টি তিনি জানেন না। বিষয়টি দেখে সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়ক বলছেন, আইসিইউটি সরকারী না, তবে এনজিও আছে বলে এখানকার বসবাসকারিদের অনেক উপকার হচ্ছে। আইসিইউ বিভাগের ডাক্তার আর সরঞ্জাম সবই এনজিও সংস্থার। সরকারী হাসপাতালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে মেশিন বসিয়ে টেস্ট করে টাকা আদায় করার বিষয়টি নজরে আনা হলে সদর হাসপাতালের প্রশাসনিক সর্বোচ্চ এই কর্মকর্তা বলেন, ‘যদি এমন হয়ে থাকে তাহলে ব্যবস্থা নিবো’।