খেলাধুলা ডেস্ক: বিশ্বকাপ মিশনে দেশ ছাড়ার আগের দিন দল ঘোষণা, মাস দুয়েক আগে অধিনায়কত্বে পরিবর্তন, ওপেনিং জুটিতে মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো পরিবর্তন— সবমিলিয়ে কিছুটা হলেও মানসিকভাবে পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ। তবে মাঠের বাইরের এসব বিতর্ক পারফরম্যান্স দিয়ে ছাপা দিতে চলেছে টাইগাররা। প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানকে ৬ উইকেটে হারিয়ে ভারত বিশ্বকাপ দারুণভাবে শুরু করেছে সাকিব আল হাসানের দল।
আজ (শনিবার) ধর্মশালার হিমাচল প্রদেশ ক্রিকেট এসোসিয়েশন স্টেডিয়ামে টস হেরে আগে ব্যাটিং করতে নেমে ৩৭ ওভার ২ বলে ১৫৬ রান তুলে অলআউট হয় আফগানিস্তান। সর্বোচ্চ ৪৭ রান এসেছে রহমানুল্লাহ গুরবাজের ব্যাট থেকে। ৩টি করে উইকেট শিকার করেছেন মেহেদি হাসান মিরাজ ও সাকিব আল হাসান। জবাবে খেলতে নেমে ৩৪ ওভার ৪ বল খেলে ৪ উইকেট হারিয়ে জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ। টাইগারদের হয়ে হাফ সেঞ্চুরি পেয়েছেন মিরাজ ও নাজমুল হোসেন শান্ত।
ছোট লক্ষ্য তাড়ায় শুরুটা ভালোই করেছিল বাংলাদেশ। দেখে-শুনে খেলছিলেন দুই ওপেনার লিটন দাস-তানজিদ তামিম। কিন্তু ৫ম ওভারেই ঘটে বিপত্তি! ফজল হক ফারুকির করা বল কাভারে ঠেলে রান নেওয়ার জন্য সামনের পায়ে একটু ঝুঁকেছিলেন লিটন। রান নেওয়ার চেষ্টা করেননি তিনি। তবে অন্য প্রান্ত থেকে তামিম ততক্ষণে দৌড়ে উইকেটের মাঝে চলে এসেছিলেন, লিটনের ডাক না শুনেই। নজিবুল্লাহ জাদরানের সরাসরি থ্রোয়ে রান আউট হন তামিম।
তানজিদ তামিমের বিদায়ের পর দ্রুত সাজঘরে ফিরে গেছেন লিটন দাসও। সর্বশেষ দুই বছরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক উইকেটকিপার এই ব্যাটার। অথচ এই ওপেনারই গত কয়েক মাস ধরে ব্যর্থতার বৃত্তে বন্দী। অবশ্য প্রস্তুতি ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হাফ সেঞ্চুরি করে ফেরার আভাস দিয়েছিলেন। কিন্তু মূল ম্যাচে এসে আবারও ব্যর্থ হলেন। ফারুকিকে এগিয়ে এসে মারতে গিয়ে আফ স্টাম্পের অনেক বাইরে থেকে বল টেনে এনে বোল্ড হন। তার ব্যাট থেকে এসেছে ১৮ বলে ১৩ রান।
দুই ওপেনারের দ্রুত প্রস্থানের পর তিনে নেমে দলের হাল ধরেন মিরাজ। শান্তকে সঙ্গে নিয়ে তৃতীয় উইকেট জুটিতে দলকে জয়ের ভীত গড়ে দেন তিনি। তুলে নেন ব্যক্তিগত হাফ সেঞ্চুরিও। এই মাইলফলক ছুঁতে তিনি খরচ করেছেন ৫৮ বল।
দুই দফা জীবন পেয়ে ফিফটি হাঁকানো মিরাজ থামেন নাভিন উল হককে মিড অফের ওপর দিয়ে তুলে মারতে গিয়ে। সাজঘরে ফেরার আগে করেছেন ৭৩ বলে ৫৭ রান। তবে আউট হওয়ার আগে বাংলাদেশের জয় একপ্রকার নিশ্চিত করেই গেছেন তিনি। এশিয়া কাপে আফগানদের বিপক্ষে সেঞ্চুরি, একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে বিশ্বকাপের ম্যাচে ফিফটি। মেহেদী হাসান মিরাজের প্রিয় প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে যেন আফগানিস্তান!
মিরাজ ফেরার পর উইকেটে এসে দ্রুতই জয়ের দিকে এগোচ্ছিলেন সাকিব। তবে ৩৪তম ওভারে ওমরজাইকে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে ডিপ স্কয়ার লেগে ধরা পড়েন। অধিনায়ক ১৪ রান করে ফিরলেও জয়ের পথে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। বাকি কাজটা মুশফিকুর রহিমকে সঙ্গে নিয়ে ভালোভাবেই সেরেছেন শান্ত। এই টপ অর্ডার ব্যাটার অপরাজিত ৫৯ রান করে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছেড়েছেন।
এর আগে বাংলাদেশের হয়ে বল হাতে ইনিংস শুরু করা তাসকিন প্রথম ওভারে বেশ আঁটসাঁট বোলিং করেছিলেন। তবে এরপর লাইন-ল্যান্থ ঠিক রাখতে পারছিলেন না। অপর প্রান্তে শরিফুল ইসলামও নতুন বলের বাড়তি সুবিধা নিতে পারেননি। টাইগার পেসারদের ব্যর্থতায় ভালো শুরুই পেয়েছিল আফগানিস্তান। ৫ ওভার শেষে বিনা উইকেটে তাদের সংগ্রহ ছিল ২৭ রান।
পেসাররা সুবিধা করতে না পারায় ইনিংসের সপ্তম ওভারেই স্পিন আক্রমণে যায় বাংলাদেশ। নিজের হাতে বল তুলে নেন সাকিব। বোলিংয়ে এসে প্রথম ওভারেই বাউন্ডারি হজম করেন এই বাঁহাতি স্পিনার। তবে পরের ওভারে এসে ঠিকই পাল্টা জবাব দিয়েছেন মিস্টার সেভেন্টি ফাইভ। এই বাঁহাতি স্পিনারকে স্লগ সুইপ করতে গিয়ে এডজ হয়ে ডিপ স্কয়ার লেগে ধরা পড়েন ইব্রাহিম। ২২ রান করা এই ওপেনারকে ফিরিয়ে আফগান শিবিরে প্রথম আঘাত হানেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।
শুরুটা দারুণ করলেও উইকেট হারানোর পর আফগানদের রান তোলার গতি কিছুটা কমে। তবে প্রথম পাওয়ার প্লের মধ্যেই প্রথম ফিফটির দেখা পায় তারা। প্রথম পাওয়ার প্লে শেষে ১ উইকেট হারিয়ে ৫০ রান তুলেছিল আফগানিস্তান। ষোলতম ওভারের প্রথম বলেই সাকিবকে বড় শট খেলতে গেলেন রহমত শাহ। অফ স্টাম্পের বাইরের বলে সুইপের চেষ্টায় টপ-এজ হয়ে বল আকাশে, সিলি মিড অফে লিটন দাস লুফে নিতে ভুল করেননি। সাজঘরে ফেরার আগে রহমতের ব্যাট থেকে এসেছে ২৫ বলে ১৮ রান।
শুরুর ১০ ওভারে ১ উইকেট হারিয়ে ৫০ রান তুলেছিল আফগানিস্তান। পরের দশ ওভারে কিছুটা হলেও রানের লাগাম টেনে ধরে বাংলাদেশ। বিশেষ করে স্পিনাররা-সাকিব আল হাসান ও মেহেদি হাসান মিরাজ। ১১-২০ ওভারের মধ্যে আফগানিস্তান তুলেতে পেরেছে ৪৬ রান। বিপরীতে তারা হারিয়েছে রহমত শাহর গুরুত্বপূর্ণ উইকেট।
উইকেটে এসে ধীর গতির শুরু করেছিলেন হাশমতউল্লাহ শাহিদি। তার এমন ব্যাটিংয়ের প্রভাব পড়েছিল দলের রান রেটের ওপরও। সেটা অধিনায়ক হয়তোবা বুঝতে পেরেছিলেন। তাইতো ২৫তম ওভারে মিরাজের ওপর আক্রমণ করতে গেলেন। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হলো না। উল্টো দলের বিপদ বাড়ান নিজের উইকেট হারিয়ে। ১৮ রান করা এই ব্যাটারকে ফিরিয়েছেন মেহেদি হাসান মিরাজ।
ইনিংস ওপেন করতে নেমে এক প্রান্ত আগলে রেখে ব্যাটিং করছিলেন রহমানুল্লাহ গুরবাজ। শুরুতে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করলেও পরে পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যাটিং করার চেষ্টা করেছেন। স্পিনার কিংবা পেসার সবার বিপক্ষেই সাবলীল ছিলেন তিনি। তবে ২৬তম ওভারে মুস্তাফিজে কাটা পড়েন তিনি। এই বাঁহাতি পেসারকে ডাউন দ্য উইকেটে এগিয়ে এসে এক্সট্রা কভারের ওপর দিয়ে হাঁকাতে চেয়েছিলেন। তবে ব্যাটারের মুভমেন্ট বুঝে গতি কমিয়ে দেন মুস্তাফিজ। ফলে ঠিকমতো টাইমিং হয়নি। ৪৭ রান করে গুরবাজ ফেরেন হাফ সেঞ্চুরি না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে।
নাজিবুল্লাহ জাদরানকে থিতু হতে দেননি সাকিব। এই বাঁহাতি স্পিনারের সোজা বলে লাইন মিস করেছেন নাজিবুল্লাহ। খানিকটা নিচু হওয়া বলে টার্নের আশায় ব্যাট চালিয়ে ছিলেন, আউটসাইড এডজে বল স্টাম্পে আঘাত হানে। ৫ রান করা নাজিবুল্লাহকে ফিরিয়ে নিজের তৃতীয় উইকেট শিকার করেন সাকিব।
টপ অর্ডার ব্যাটারদের কল্যাণে ভালো শুরুই পেয়েছিল আফগানিস্তান। তবে মিডল অর্ডার ভেঙে যায় তাসের ঘরের মতোই। ১০ রানের ব্যবধানে ফিরেছিলেন-হাশমতউল্লাহ-গুরবাজ-নাজিবুল্লাহ। তাই মোহম্মদ নবির দায়িত্বটা বেড়ে গিয়েছিল। তার অভিজ্ঞতায় ভরসা খুঁজছিল আফগানরা। ব্যর্থ হলেন তিনিও। তাসকিনের ল্যান্থ বলে ইনসাইড এডজে লেগ স্টাম্প উপড়ে গেছে এই অভিজ্ঞ ব্যাটারের। সাজঘরে ফেরার আগে তার ব্যাট থেকে এসেছে ৬ রান।
মিডল অর্ডার ব্যাটাররা ব্যর্থ, তবে লোয়ার মিডল অর্ডারে পার্থক্য গড়ে দিলেন রশিদ, এমনটা অনেকবারই ঘটেছে আফগানিস্তান ক্রিকেটে। তবে আজ চিত্রটা ছিল ভিন্ন। ধর্মশালায় যখন ধুঁকছে দল, তখন বিপদ বাড়িয়ে ফেরেন রশিদও। মিরাজের নিচু হওয়া বল স্টাম্পে ডেকে এনে বোল্ড হয়েছেন তিনি।
প্রথম স্পেলে সুবিধা করতে পারেননি শরিফুল ইসলাম। মাঝে স্পিনাররা ভালো করায় শরিফুলের শরণাপন্ন হননি সাকিব। তবে দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে উইকেটের দেখা পান এই বাঁহাতি পেসারও। ৩৬তম ওভারের দ্বিতীয় বলে আজমতউল্লাহ ওমরজাইকে বোল্ড করেছেন তিনি। দলীয় ১৫৬ রানে আউট হয়েছেন ওমরজাই। সেই একই রানে পরের দুই উইকেটও হারিয়েছে আফগানিস্তান। ফলে ১৫৬ তেই আটকে যায় তারা।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
আফগানিস্তান: ৩৭.২ ওভারে ১৫৬ (গুরবাজ ৪৭, ইব্রাহিম ২২, রহমাত ১৮, শাহিদি ১৮, নাজিবউল্লাহ ৫, নবি ৬, ওমারজাই ২২, রশিদ ৯, মুজিব ১, নাভিন ০, ফারুকি ০*; তাসকিন ৬-০-৩২-১, শরিফুল ৬.২-১-৩৪-২, মুস্তাফিজ ৭-১-২৮-১, সাকিব ৮-০-৩০-৩, মিরাজ ৯-৩-২৫-৩, মাহমুদউল্লাহ ১-০-৭-০)
বাংলাদেশ: ৩৪.৪ ওভারে ১৫৮/৪ (তানজিদ তামিম ৫, লিটন ১৩, মিরাজ ৫৭, শান্ত ৫৯*, সাকিব ১৪, মুশফিক ২*; ফারুকি ৫-০-১৯-১, মুজিব ৭-০-৩০-০, নভিন ৫.৪-০-৩১-১, রশিদ ৯-০-৪৮-০, নবি ৬-১-১৮-০, ওমারজাই ২-০-৯-১)