নিজস্ব প্রতিবেদক: চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেছেন, হাজার বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে নৌকাগুলো রয়েছে সেগুলোর স্মৃতি নিয়ে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট এলাকার ২৫ একর জায়গার উপর গড়ে উঠা ডিসি পার্কের পাশে একটি নৌকা মিউজিয়াম করা হবে। সেখানে বড় আকারে ময়ুর-পঙ্খী, বজরা, সাম্পান, বিভিন্ন ধরণের নৌকার রেপ্লিকা থাকবে। ভবিষ্যতে এগুলোতে থ্রিডির মাধ্যমে এগুলোর ফ্যাসিলিটিস রাখার বিষয়ে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে, যাতে করে ঝড়ের সময় জেলে ও মাঝি-মাল্লারা নৌকা নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা সাজাতে পারেন। আমাদের দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরার জন্য এ উদ্যোগ নেয়া হবে।
২৭ সেপ্টেম্বর (বুধবার) সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে জেলা প্রশাসন আয়োজিত বিশ্ব পর্যটন দিবসের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। আলোচনা সভার পূর্বে বেলুন উড়িয়ে বিশ্ব পর্যটন দিবসের শুভ উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক।
এরপর একটি বর্ণাঢ্য র্যালি বের করা হয়। র্যালিটি প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়-‘পর্যটনে পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগ’। আলোচনা সভা শেষে বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে আয়োজিত রচনা ও চিত্রাংকন প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। অনুষ্ঠানে পর্যটকদের সুবিধার্থে অনলাইন টিকেট বুকিং সিস্টেমের স্মারক ডাক টিকেটের উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক।
জেলা প্রশাসক বলেন, গুলিয়াখালী বীচ ও খৈয়াচড়া বীচের রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দেয়া হয়েছে। পতেঙ্গা সী-বীচের বেহাল অবস্থা। সেখানে টয়লেট-ওয়াশরুম স্থাপন, পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, লকার রুম, সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও ব্রেস্টফিডিং কর্ণার স্থাপনসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হবে। পর্যটন এলাকা হিসেবে শুধু পতেঙ্গা সী-বীচে নয়, প্রত্যেক পর্যটন স্পটে ট্যুর আপারেটরদের নিয়ে হোটেল-রেস্টুরেন্ট উন্নতমানের খাবারের বিষয়টিও নিশ্চিত করা হবে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রাকিব হাসানের সভাপতিত্বে, সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট (শিক্ষা ও আইসিটি) আবদুল্লাহ আল-মামুনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন জেলা পুলিশ সুপার এস.এম সফিউল্লাহ, ট্যুরিস্ট পুলিশ সুপার আপেল মাহমুদ, মহানগর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর আহমদ, জেলার ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম সরওয়ার কামাল দুলু। স্বাগত বক্তব্য রাখেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এল.এ) মোঃ আবু রায়হান দোলন।
অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. তৌহিদুল আরিফ, জেলা প্রশাসনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার জামশেদ আলম রানা, পর্যটন হোটেল সৈকতের ব্যবস্থাপক মোঃ সারেয়ার উদ্দিন, চিটাগাং অনলাইন ট্রাভেল এডমিন গ্রোজ (কট্যাগ) এর সদস্য রাশেদুল হাসান ইমন।
জেলা প্রশাসন, পর্যটন করপোরেশন, ট্যুরিস্ট পুলিশ ও বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
বিশ্ব পর্যটন দিবসের আলোচনা সভায় জেলা প্রশাসক (ডিসি) বলেন, আমাদের ভালো থাকার জন্য ট্যুরিজম প্রয়োজন। গার্মেন্টস সেক্টর ও বৈদেশিক রেমিটেন্সের বাংলাদেশের অর্থনীতি নির্ভর করে। গার্মেন্টস সেক্টর কর্মসংস্থানের জন্য একটি বড় ধাপ। প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষ এ খাতে কাজ করে। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ট্রান্সপোর্ট সেক্টরসহ বিভিন্ন আরও যে সেক্টরগুলো রয়েছে সেগুলোতে মিলিয়ন মানুষকে কাজে লাগানো যাবে। সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। একইভাবে পর্যটন খাতকে যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি, চাঙ্গা করতে পারি তাহলে অর্থনীতিতে বাংলাদেশ আরও অনেকদূর এগিয়ে যাবে।
ডিসি বলেন, শ্রীলংকা দু’বছরের মধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কারণ তাদের ট্যুরিজম সেক্টর প্রসারিত হয়েছে। তাদের সে সুযোগটি রয়েছে, বেশি ইনভেস্টমেনেরও প্রয়োজন নেই। এ দেশে আগের তুলনায় আমাদের ডোমেস্টিক ট্যুরিজম অনেকটা প্রসারিত হয়েছে। আমাদের চট্টগ্রামে যে ট্যুরিস্ট স্পটগুলো রয়েছে সেগুলোকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারছি না। আমাদের পতেঙ্গা সী-বীচে যাওয়ার জন্য জনসাধারেণের অনেক ভোগান্তি হয়। সেটির কথা বিবেচনা করে আমরা বিআরটিসির সাথে যোগাযোগ করেছি। সৌভাগ্যবশত সড়ক ও মহাসড়কে বিভাগের সচিবের সাথে যোগাযোগ করার পর বিআরটিসি’র চেয়ারম্যান সাথে সাথে রাজি হয়ে ২টি পর্যটক বাস দিয়ে দিয়েছেন (১টি ছাদ খোলা)।
ট্যুরিস্ট স্পটে যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে জেলা প্রশাসক বলেন, আমি আরও ৪টি বাস চেয়েছি, এর মধ্যে একটি ছাদ খোলা বাস গতকাল এসেছে। আমরা আশা করছি, আরও কিছু ছাদ খোলা বাস চট্টগ্রামে পাবো এবং ট্যুরিস্টদের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে। বিআরটিসির কাছে মেয়েদের জন্য ৪টি ডেডিকেটেড বাস চেয়েছি, আশাকরি সেগুলো আমরা পাবোই।
চলতি মৌসুমে রিভার ক্রুজ চলা করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা আশা করছি আগামী ১ থেকে দেড় মাস অর্থ্যাৎ আগামী ১৫ নভেম্বরের মধ্যে আমরা রিভার ক্রুজ চালু করবো, এ ব্যাপারে ওয়েস্টার্ন মেরিন ও কর্ণফুলি নামক দু’টি বড় প্রতিষ্ঠানের সাথে কথা হয়েছে। তারা আমাদেরকে তাদের দুটো জাহাজ দেবে এবং আমরা প্রাথমিকভাবে শুক্র-শনিবারে এগুলো চালু করবো।
তিনি বলেন, যারা প্রাইভেট ট্যুর অপারেটর আছে তাদেরকে নদীতে ডে ট্যুর বোট চালু করার জন্য আমরা অনুরোধ করেছিলাম। আমরা সার্ভিস প্রোভাইডার না হলেও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা করবো। আমরা যখন পর্যটক বাস চালু করি, তার আগে তাদেরকে অনুরোধ করেছিলাম। কেউ সাড়া দেননি। আপনাদেরকে উদ্যোগ নিতে হবে, দু’একবার ফেল করবেন, তারপর সাকসেস হবেন। সাহস করতে হবে।
প্রাইভেট ট্যুর অপারেটরদের উদ্দেশ্যে ডিসি বলেন, সরকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাদের ব্যবসা করার কথা নয়, ছোট ইনভেস্টমেন্ট করেন, লস হওয়ার চান্স নেই, যদি লোন লাগে তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকে আমি অনুরোধ করবো। ট্যুরিজমের জন্য বেসরকারী পর্যায়ে সদরঘাট টু কাপ্তাই পর্যন্ত নদী পথে ছোট ছোট বোটকে টার্গেট করতে পারেন। কাপ্তাই রুটে একটি চমৎকার নদী পথ রয়েছে। আপনারা বোট চালু করলে লসের কোন চান্স নেই। চট্টগ্রাম সিটি বেইজ ট্যুরিজমের কিছু সুযোগ রয়েছে।
তিনি আরও বরেন, কর্ণফুলী টানেল হয়ে যাচ্ছে। এটি চালু হলে আমরা পার্কি বীচসহ অন্যান্য পর্যটন স্পটের জন্য ডে ট্যুর চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে ৪টি এসি বাস বিআরটিসির কাছে চেয়েছি। এগুলো দেয়া হলে টানেলভিত্তিক ট্যুরিজম নিয়ে কাজ করতে চাই।
জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতবর্ষের যে বিদ্রোহের সুতিকাগার চট্টগ্রাম। ইউরোপিয়ান ক্লাব, মাস্টার দা সূর্য সেনের পৈত্রিক ভিটা, ফয়স লেক, চিড়িয়াখানা আছে, সেগুলো নিয়ে আপনারা ট্যুরিজমের চিন্তাভাবনা করতে পারেন। অনেক দেশি-বিদেশী এখান থেকে অভিজ্ঞতা নিতে চায়। কাট্টলীর রানী-রাসমনি ও আকমল আলী ঘাটে জেলে পল্লী আছে, তাদেরকে নিয়ে কথা বলতে পারেন। ৫/১০টি পরিবার নিয়ে তাদের লাইফ স্টাইল নিয়ে আপনারা কাজ করতে পারেন, তাবু নিয়ে অবস্থান করে দেখতে পারেন যে তাদের জীবন কেমন কাটে। তাদের খাবারের ব্যবস্থাসহ সেখানে কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম করতে পারেন। ট্রাইবাল কমিউনিটি, ফিস মার্কেট, টি গার্ডেন নিয়ে কাজ করতে পারেন, এগুলো চট্টগ্রামের ঐতিহ্য।