প্রতিনিধি ১৫ জুন ২০২৩ , ৯:৪৩:৪৪ প্রিন্ট সংস্করণ
চট্টবাণী: একুশে পদকপ্রাপ্ত সমাজবিজ্ঞানী ও প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. অনুপম সেন বলেছেন, নারীদের অন্তঃপুরে রাখলে দেশের সমৃদ্ধি হবে না। উন্নয়নের সাথে নারীদের মুক্তি অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িত।
যদি দারিদ্রের অভিশাপ থেকে মানুষ মুক্ত না হয় তাহলে কোনোদিন সমতা প্রতিষ্ঠা হবে না। প্রতিটি মানবসত্তাকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, সংস্কৃতি ও অবকাশের অধিকার দিতে হবে।
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ (বিএনপিএস), চট্টগ্রাম কেন্দ্রের আয়োজনে এবং প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যোশিওলজি এন্ড সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের সহযোগিতায় এই সেমিনারের আয়োজন করা হয়। বৃহস্পতিবার (১৫ জুন) প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে একুশে পদকপ্রাপ্ত সমাজবিজ্ঞানী ও প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. অনুপম সেন বলেন, অতীতে নারীরা অনেক পিছিয়ে ছিল। শিক্ষায়, কর্মক্ষেত্রে এবং সমাজ জীবনে। আজ অনেক এগিয়েছে। তবে সমতা প্রতিষ্ঠার লড়াই আমাদের আরও অনেকদিন চালিয়ে যেতে হবে। কোনো একটি জাতির অগ্রগতির জন্য আগে বহিঃশক্তির প্রভাব তথা ঔপনিবেশিক শক্তির প্রভাব থেকে মুক্ত হতে হবে। পরাধীনতা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীনতা পেলেই, শ্রেণি সংগ্রাম যাত্রা শুরু করতে পারে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।
সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন বলেন, সত্যিকারের সমতা কোথা থেকে আসতে পারে? উন্নয়নের সাথে নারীদের মুক্তি অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িত। প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে নারীদের স্বাধীনতা ছিল না। রোম কার্টেজ যুদ্ধের সময় যখন পুরুষেরা যুদ্ধে গেল তখন মেয়েরা এগিয়ে আসে নানা কাজে। একই ঘটনা ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। কারণ ছেলেরা তখন যুদ্ধে। তখন থেকেই মেয়েরা কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হলো। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত মেয়েদের ভোটের অধিকারই ছিল না। আজ প্রায় সব দেশে আছে। আজকের আলোচনায় জিডিপির কথা এসেছে। মেয়েরা ঘরে বসে রান্নাকরা, গৃহস্থালি এমন অনেক কাজ করে যা বাজারে আসে না। ফলে সেগুলো জিডিপিতে যোগ হয় না৷ তাই মেয়েরা যদি কর্মক্ষেত্রে না আসেন, তাহলে তা জিডিপিতে যোগ হবে না। মেয়েদের অন্তঃপুরে রাখলে দেশের সমৃদ্ধি হবে না।
ড. অনুপম সেন বলেন, সমতার সংগ্রাম আজো চলছে বিশ্বব্যাপী। প্রতিটি শিশু জন্মায় বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে। কিন্তু কোন শিশু তার সম্ভাবনার বাস্তব রূপ দিতে পারবে, তা নির্ভর করে পরিবারের সক্ষমতার মধ্যে। যে শিশু সড়কে জন্মায় সে একটা জীব হিসেবে থেকে যায়। যদি দারিদ্রের অভিশাপ থেকে মানুষ মুক্ত না হয় তাহলে কোনোদিন সমতা প্রতিষ্ঠা হবে না। প্রতিটি মানবসত্তাকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, সংস্কৃতি ও অবকাশের অধিকার দিতে হবে। যে প্রকৃত শিক্ষা পেল না, সে জানলই না মানবসত্তা কী। এ সবকিছু মিলেই মানবাধিকার। এক শতাংশ লোকের হাতে নব্বই শতাংশ অর্থ পুঞ্জিভূত হলে সেখানে প্রকৃত মানবাধিকার থাকতে পারে না। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি তাই। তাদের দেশের ৩৪% লোকের ব্যাংকে একশ ডলারও নেই। বাংলাদেশে হয়ত ৮০% লোকের ব্যাংক একাউন্টই নেই। সমতা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই মানবাধিকার ও স্বাধীনতার আসল অর্জন লাভ সম্ভব হবে।
সেমিনারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের প্রাক্তন ডিন প্রফেসর হোসাইন কবীর বলেন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রেখে ইহজাগতিক মূল্যবোধ বাস্তবায়ন অসম্ভব৷ এদেশে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত ভূমি ব্যবস্থাপনা। যার ফলে বৈষম্য পরিবারেও ছড়িয়েছে। রাষ্ট্রতো মসজিদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যেতে পারে না। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল নাগরিকদের ধর্ম পালনে সুরক্ষা দেয়া। অথচ আমাদের দেশে রাষ্ট্র এমন বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। নারী-পুরুষের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য এখন ধর্মীয়, জাতিগত ও অর্থনৈতিক। গত বুধবার জামালখান মোড়ে বঙ্গবন্ধু প্রতিকৃতি ভেঙ্গেছে তারুণ্য সমাবেশে যাওয়ার সময় একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীরা। বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতির পিতা। অথচ তারা বঙ্গবন্ধুকে আঘাত করল। বাংলাদেশকে আঘাত করল। আমরা কাদের নিয়ে সামনে যাব? ধর্মীর চেতনা মাথায় রেখে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব না। এদেশে বীর প্রতীক কানন বিবি, তারামন বিবিকে খুঁজে পেতে অনেক বছর সময় লেগেছে। ভূমি ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় বিধানে নারী মুক্তি হয়নি। এভাবেই জেন্ডার বৈষম্য জিইয়ে আছে।
সভাপতির বক্তব্যে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. কাজী শামীম সুলতানা বলেন, আজকের তরুণরা-শিক্ষার্থীরা যখন সচেতন হবে তখনই আমরা সমতার পথে এগুতে পারব। শুধু নারীর অধিকার নয় তৃতীয় লিঙ্গসহ সকল লিঙ্গের মানুষের অধিকার, একটি মৌলিক মানবাধিকার। এটা টেকসই উন্নয়ন ও একটি শান্তিপূর্ণ সমাজের জন্য অত্যাবশ্যক। নারীর সার্বিক উন্নয়নে বড় নিয়ামক শিক্ষা। তাই পরিবারের মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। সমতার অনুশীলন পরিবার থেকে শুরু করে সকল প্রতিষ্ঠানে, প্রাত্যহিক জীবনে করে যেতে হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলা উদ্দিন বলেন, গণতন্ত্র ও সেকুলারিজম থাকলে, সমনাগরিকত্ব চলে আসবে। রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে সভা, সেমিনার আয়োজন এবং প্রাত্যহিক জীবনে অনুশীলন বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলে বৈষম্য দূর হবে। লিঙ্গ সমতা ও সমনাগরিকত্ব প্রতিষ্ঠা একার পক্ষে সম্ভব না। সমন্বিতভাবে করতে হবে। গণতান্ত্রিক দেশে মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে টেকসই উন্নয়ন করতে হবে। আর এটি করতে হলে ধর্ম জাতি নির্বিশেষে বৈষম্যহীন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। দেশে বৈষম্যমূলক আইন আছে। এসব সংস্কার প্রয়োজন, করতে হবে। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা বাদ দিতে হবে। নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর জন্য শিক্ষার প্রচারণা ও সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন। আমাদের রাষ্ট্রের চার নীতি যদি রাজনৈতিকভাবে নিশ্চিত করা যায় তাহলে জেন্ডার সমতা বাস্তবায়ন সম্ভব।
প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রামের স্যোশিওলজি এন্ড সাস্টেইনেবেল ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের কো অর্ডিনেটর ড. সাদিকা সুলতানা চৌধুরী বলেন, নারী পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠায় বৈষম্য দূর করতে হবে। জেন্ডার সমতা নিশ্চিত হলে উন্নত মূল্যবোধ চর্চা বাড়বে। আমরা তৃতীয় লিঙ্গ এবং খাটো লোকদের হেয় করি, এসব বৈষম্য আমাদের সমনাগরিকতত্ব প্রতিষ্ঠায় বাধা হয়।
ধারণাপত্র উপস্থাপন করে বিএনপিএস চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মো. ফেরদৌস আহম্মদ বলেন, বিএনপিএস কাজ করে নারী পুরুষের জীবনমান উন্নয়নে। সমাজে যে বৈষম্যের উপাদান বিরাজমান তা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছি। এদেশে ধর্মকে সুকৌশলে ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। ধর্মকে আশ্রয় করে সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এর শিকার দরিদ্র ও দুস্থ পরিবারে নারী ও শিশুরা। ৭৫ পরবর্তী পটপরিবর্তনে রাষ্ট্রের মূলনীতিকে পাশ কাটিয়ে দেশ পরিচালনা শুরু হয়। মূলনীতি বাস্তবায়ন না হওয়ায় দেশে জেন্ডার বৈষম্য বাড়ছে।
সেমিনারে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ চট্টগ্রাম কেন্দ্রের উন্নয়ন কর্মকর্তা এম এম এরশাদুল করিম।