চট্টবাণী ডেস্ক: বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নাগরিকেরা আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকিস্বরূপ বলে মন্তব্য করেছেন মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। মঙ্গলবার (১৩ জুন) বিকেলে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে তিনি এ মন্তব্য করেন।
মোজাম্মেল হক বলেন, দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা নিয়ে বৈঠকে দীর্ঘক্ষণ আলাপ-আলোচনা করেছি। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে এবং আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে জনগণ স্বস্তিতে আছে বলে আমাদের মূল্যায়ন। যদিও ছোটখাট ঘটনা ঘটে, এটি স্বাভাবিক। এমন কোনো মেজর ঘটনা ঘটেনি যাতে উদ্বিগ্ন হতে হয়।
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে তারপরও আমরা উদ্বিগ্ন, তা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে। সেখানে (ক্যাম্পগুলোতে) মাদক, নাশকতা ইত্যাদি বন্ধ করা যাচ্ছে না। আমরা আইডি কার্ড না দিলেও তারা যেভাবেই হোক সিম কার্ড এনে ব্যবহার করে। আমাদের দেশ থেকে পাচ্ছে না। কিন্তু মিয়ানমার থেকে সিম কার্ড এনে সেগুলো ব্যবহার করে। তারা অত্যন্ত আনরুলি, আপনারা দেখেছেন। পৃথিবীর অনেক দেশেই শরণার্থীরা থাকে, তারা কিন্তু আবদ্ধ থাকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দেশের মানুষ শরণার্থী ছিল, তারা কখনোই সেই দেশের আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করেনি বা সে দেশের কোনো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়নি।
মন্ত্রী বলেন, আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, মিয়ানমার থেকে যে রোহিঙ্গারা এ দেশে আশ্রয় নিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী সদয় হয়ে যাদের আশ্রয় দিয়েছেন, তারা আইনশৃঙ্খলার জন্য খুবই হুমকিস্বরূপ আরকি। নিজেরা আইনশৃঙ্খলা মানতে চায় না। তাদের জন্য ভাসানচরে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সেখানে যে সুব্যবস্থা আছে, সেখানেও তারা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, সেখানে (ক্যাম্পে) তারা বিভিন্ন স্থানীয় ক্রাইমের সঙ্গে, জাতীয় ক্রাইমের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলছে এবং নিজেদের মধ্যেও মারামারি, হানাহানি, মাদক কারবার ইত্যাদিতে জড়াচ্ছে। তারা যেভাবে আছে, মানবিক কারণে কিছু বলাও যায় না। যেহেতু তারা আশ্রিত, আমাদের দেশের আইন দিয়ে তাদের গ্রেপ্তারও করা যায় না, বিচারও করা যায় না। কারণ তারা তো আমাদের দেশের নাগরিক না। তাদের বিচার করা, গ্রেপ্তার করার দেশে কোনো আইন নেই। কিছু করাও যায় না আইনানুগভাবে।
মন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থা সেখানে আছে, আমরা মনে করি তাদের মদদে তারা উৎসাহ পায়। এদের জন্য এদেশের আইন দিয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণও করা যাচ্ছে না। তারপরও আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিজিবি সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কীভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা যায়।
মাদকের বিষয়ে সরকারের জিরো টলারেন্সের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি, চাকরিতে আবেদনে ডোপটেস্ট করতে হবে। ডোপটেস্টের মেয়াদ খুব অল্পকাল। তিন দিন পরে গেলেই অর্থাৎ তিন দিন মাদক সেবনে বিরত থাকলেই ডোপটেস্টে আর ধরা পড়বে না। তারপরও ডোপটেস্টের মাধ্যমে কিছু মানুষের চাকরি চলে গেছে। পুলিশ বাহিনীর লোকই সবচেয়ে বেশি চাকরিচ্যুত হয়েছে।
মাদকসেবীদের নিরুৎসাহিত করার জন্য প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, আমরা উদ্বিগ্ন, মাদকসেবীদের সংখ্যা আমাদের আশানুরূপ কমেনি, অনেকক্ষেত্রে বেড়েছে। কীভাবে মোটিভেশন চালানো যায়, অভিভাবকদের সঙ্গে সমাবেশ করা যায়, স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছি। জাতির জন্য এটি উদ্বেগের কারণ। মাদকসেবীদের নিরুৎসাহিত করতে গণমাধ্যমকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
তিনি বলেন, মাদকসেবীদের জন্য নিরাময়কেন্দ্র সরকারি-বেসরকারিভাবে রয়েছে, সেগুলো খুব একটা মানসম্পন্ন নয়। সরকারি নিরাময়কেন্দ্রগুলোর আসন বাড়াতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে বেশ কিছু আসন বাড়ানো হয়েছে। বিভাগীয় শহরে নিরাময় কেন্দ্র স্থাপনের জন্য সরকারি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। মাদকের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা থাকলেও জঙ্গিবাদ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি। এককালে যেভাবে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছিল, তা স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখতে সরকার সক্ষম হয়েছে। অন্যান্য দেশের তুলনায় এদেশে জঙ্গিবাদ খুবই সহনশীল পর্যায়ে আছে। জঙ্গি দমনে পুলিশের নতুন শাখা হয়েছে- এটিইউ ও সিটিটিসি।
মাদক নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, মাদক যেসব রুটে আসে তা বন্ধ করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিজিবি, র্যাব, পুলিশসহ সবাই তৎপর। সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ২২ কেজি আইস নামে মাদক উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার যে হচ্ছে না তা কিন্তু না। এটা ঠিক যে, নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বন্ধের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আজ আরও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে, কোনো রুট দিয়ে যেন মাদক ঢুকতে না পারে।
মোজাম্মেল হক বলেন, কারা হুন্ডির মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে সেগুলো দেখার জন্য, হুন্ডির মাধ্যমে টাকা যাতে পাচার না হয়, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অল্পসংখ্যক এনজিও, শতাধিকও হতে পারে, তারা কোথা থেকে ফান্ড পায়, টাকা কোথায়, কীভাবে খরচ করে, এসব তথ্য অডিট রিপোর্টের মতো এনজিও ব্যুরোকে দেওয়ার নিয়ম আছে।
তিনি বলেন, অনেক এনজিও আছে নিয়মকানুন মেনে চলে না। সেজন্য এনজিও ব্যুরোকে আজকের সভা থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, এনজিওগুলো যাতে হিসাবপত্র যেটা দেওয়ার কথা, অডিট রিপোর্ট দেওয়ার কথা, তা যেন দেয়। যেগুলোতে সন্দেহজনক লেনদেন হয়, সেগুলোর তথ্য পুলিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেবে। সন্দেহজনক লেনদেন থাকলে পুলিশ বিভাগ সেগুলো খতিয়ে দেখবে, তদন্ত করে দেখবে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্দেহজনক লেনদেন হয়, এনজিও সংস্থাগুলোর কাছ থেকে এরকম কোন তথ্য এসেছে কি না, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, এসব এনজিও নিয়েতো পত্র-পত্রিকায় লেখা হয়। শোনা কথার ওপর তো সিদ্ধান্ত হয় না। সিদ্ধান্ত নিতে হয় তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যেসব লেনদেন সন্দেহজনক, সেগুলোর রিপোর্ট আমরা এনজিওগুলোর কাছে চেয়েছি। আমাদের যা বলা হয়েছে, তা সঠিক কি না, তা যাচাইয়ের জন্য এ তথ্য চাওয়া হয়েছে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামকে আবার মাঠে নামানো হলো- মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী হিসেবে বিষয়টি কীভাবে দেখছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন। এটি রাজনৈতিক প্রশ্ন। এর জবাব দেবেন আওয়ামী লীগের যিনি মুখপাত্র, তিনি। এই মুহূর্তে আমি মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী হিসেবে কোনো মন্তব্য করছি না। আমি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সভা করেছি। সেটাতেই সীমাবদ্ধ থাকি।
জামায়াত মাঠে নামলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ডাউন হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এ রকম মনে করছি না। মাঠে নামলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যারা নস্যাৎ করে, তারা যদি মাঠে না নামে, তাহলে আরও বেশি করবে। মাঠে নামলেই যে হয়, তা নয়। আমরা সবসময় চাই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকুক। আওয়ামী লীগ সবসময় নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। মানুষ তার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করুক। ভোট হলো গণতান্ত্রিক অধিকার। সেই অধিকার যাতে সুষ্ঠু-সুন্দরভাবে প্রয়োগ করতে পারে, তাতে আমরা বিশ্বাস করি।
সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, অপরাধী যেই হোক, সেটা জামায়াত হোক, সরকার দলের হোক, বিরোধী দলের হোক বা কোন দল করে না শুধু দুর্বৃত্ত, যেই হোক, আইনশৃঙ্খলা যারা লঙ্ঘন করেছে, বিশেষ করে যাদের ওপেন অস্ত্র নিয়ে দেখা গেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, বিদেশে বসে কয়েকজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে মিথ্যাচার করছে। চমকপ্রদ ও আজগুবি কথা বলছে, যাতে মানুষ বিভ্রান্ত হয়। একেকদিন একেক রকম গুজব তারা ছড়ায়, দেশবাসীর জন্য যা খুব অকল্যাণকর। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, আমাদের দেশে সেসব প্রতিষ্ঠানের অফিস না থাকার কারণে আমরা তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারি না। যারা এগুলো করে তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক, এই কামনা করছি।
মন্ত্রী বলেন, অনিবন্ধিত যেসব অনলাইন পত্রিকা আছে সেগুলোকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিবন্ধন নেওয়ার অনুরোধ করছি। কারণ রেজিস্ট্রেশন থাকেলে জবাবদিহিতা চাওয়া যায়। নীতিমালা ভঙ্গ করলে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা যায়। রেজিস্ট্রেশনবিহীন, নামসর্বস্ব পত্রিকা মানুষকে আরও বিভ্রান্ত করার সুযোগ পায়। সে কারণে আমাদের আহ্বান অনলাইন পত্রিকা যারা চালান, রেজিস্ট্রেশন করুন। নির্ধারিত নিয়মে এবং নির্ধারিত সময়ে রেজিস্ট্রেশন না করলে সেগুলো যাতে বন্ধ করে দেওয়া হয়। নইলে যারা ভালো নিউজ করে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।