চট্টবাণী ডেস্ক: বাংলা সাহিত্যের নক্ষত্রপতন। চলে গেলেন অনিমেষ, মাধবীলতার স্রষ্টা।
না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন প্রবাদপ্রতিম কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। গত বেশ কিছু দিন ধরেই সিওপিডির সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি।
কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে সোমবার (৮ মে) স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা ৪৫ নাগাদ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি।
বেশ কিছুদিন ধরে ফুসফুস ও শ্বাসনালির সংক্রমণের কারণে তাকে কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার রক্তে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রাও বেড়ে গিয়েছিল বলে হাসপাতালের সূত্র জানিয়েছে। তিনি ভর্তি ছিলেন হাসপাতালের আইসিইউতেও।
‘সাতকাহন’ থেকে ‘গর্ভধারিনী’, ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’, অর্জুন, মেজরের অ্যাডভেঞ্চারসহ বাংলা সাহিত্যের একের পর এক ক্লাসিক সৃষ্টির রূপকার তিনি।
তার জন্মের সময় পুরোদমে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যার ছাপ খানিক পড়েছিল উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চলেও। এই উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সেই কেটেছে সমরেশ মজুমদারের ছাত্রজীবন। তার গল্পে, উপন্যাসে বার বার ঘুরেফিরে এসেছে উত্তরবঙ্গের অনন্য সৌন্দর্য। জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে পড়েছেন। তারপর চলে আসেন কলকাতায়। ভর্তি হন স্কটিশচার্চ কলেজে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন তিনি। পরে স্নাতকোত্তরে পড়েন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
লেখালেখির জগতেও প্রবেশ বাংলার একটি বিখ্যাত পত্রিকার হাত ধরে। প্রথম লেখা প্রকাশ ওখানেই। পরে কর্মসূত্রেও জড়িয়ে ছিলেন বাংলার একটি প্রথমসারির পত্রিকা গোষ্ঠীর সঙ্গে। তবে সমরেশ মজুমদারকে একধাক্কায় খ্যাতির আলোয় নিয়ে আসে তার বিখ্যাত ‘ট্রিলজি’। ‘উত্তরাধিকার’ যার প্রথম খণ্ড। পরের খণ্ড ‘কালবেলা’ আজও বাংলা সাহিত্যের অন্যতম আধুনিক ক্লাসিক বলে স্বীকৃত। কলকাতার উত্তাল নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা স্লোগান, বিপ্লব, রক্ত, বোমা ও প্রেমের এক তোলপাড় ফেলা কাহিনীর জন্য ১৯৮৪ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত করা হয় তাকে।
বিপ্লব, সংগ্রাম ও জীবনকে অন্যভাবে যাপনের কাহিনী কখনও তিনি ছেড়ে যাননি। তার ‘গর্ভধারিনী’ উপন্যাস কার্যত বৈপ্লবিক। সমাজতন্ত্র, সমাজ পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে হিমালয়ের কোলে, সান্দাকফু পেরিয়ে এক বরফঢাকা গ্রামে নিয়ে গিয়েছিলেন তার উপন্যাসের তরুণ চরিত্রদের। গোয়েন্দা-গল্পেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
তার লেখা অর্জুনের গল্পে বিভোর থেকেছে পাঠকরা। বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা কম নেই। ফেলুদা, ব্যোমকেশ সবাই সক্রিয়ভাবে বিরাজ করছেন আজও। কিন্তু, সবাই কলকাতায় থাকেন। রহস্য ধরতে হিল্লি-দিল্লি যান। সেখানে সমরেশের গল্পের গোয়েন্দা, তথা, সত্যসন্ধানী অর্জুন জলপাইগুড়ির ছেলে। কলকাতাতেও কেস সলভ করতে আসেন। কিন্তু তার আসল জায়গা জলপাইগুড়ি।
মফস্বল শহর, তার মানুষ, জলপাইগুড়ির আশেপাশে তিস্তা, তোর্সা ইত্যাদি নদী ছাড়িয়ে জলদাপাড়া, মাদারিহাট, বীরপাড়া, মালবাজার, রাজাভাতখাওয়া, হলং, গরুমারা ইত্যাদি ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ পাহাড় জঙ্গলে আর চা বাগানে ঘেরা এক প্রাকৃতিক পরিবেশে গজিয়ে ওঠে নানা ভয়ানক রহস্য।
‘খুঁটিমারি রেঞ্জ’, ‘খুনখারাপি’, ‘কালিম্পং-এ সীতাহরণ’ ইত্যাদি গল্পে দুরন্ত রহস্য সমাধান করে অর্জুন। তার লাল মোটরবাইক কার্যত এক ‘আইকনিক’ অংশ হয়ে ওঠে গল্পের। লেখক অর্জুনকে শুধু বাংলাতেই আটকে রাখেননি। নিয়ে গিয়েছিলেন আমেরিকায়, অর্জুন কেস ধরেছে একেবারে নিউইয়র্ক সিটিতে।
উত্তরবঙ্গের সমস্ত সৌন্দর্য, আবেগ, রহস্য ধরা দিত তার কলমে। কলকাতাবাসী বহু পাঠক তার লেখাতেই চিনেছিল জলপাইগুড়ি শহরের কদমতলা, রূপমায়া সিনেমা, হাকিমপাড়া, শিল্পসমিতিপাড়া, রায়কতপাড়া। দীর্ঘদিনের অসুস্থতার কাছে হার মানল সেই সমরেশ।