• জাতীয়

    ঢাকা উত্তর বিএনপির এক ডজন নেতার পদত্যাগ

      প্রতিনিধি ২১ ডিসেম্বর ২০২২ , ৮:২২:১৯ প্রিন্ট সংস্করণ

    চট্টবাণী: ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির ওয়ার্ড কমিটি গঠনে পদ বাণিজ্য এবং আঞ্চলিক সম্পর্ককে প্রাধান্য দেওয়ার অভিযোগে পদত্যাগ করলেন অন্তত এক ডজন নেতা।

    সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজ নিজ আইডি থেকে পদত্যাগের বিষয়টি পোস্ট করেছেন পদত্যাগকারীরা।



    সম্প্রতি ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির ১০ ওয়ার্ডে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। সংগঠনের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ্ আমান ও সদস্য সচিব আমিনুল হক এ কমিটির অনুমোদন দেন।

    এর মধ্যে রয়েছে রূপনগর থানার ৬নং আঞ্চলিক ওয়ার্ড, শাহআলী থানার ৮ ও ৯৩নং ওয়ার্ড, কাফরুল থানার ৪নং ওয়ার্ড, আদাবর থানার ৩০ ও ১০০নং ওয়ার্ড, মোহাম্মদপুর থানার ৩১, ৩২, ও ৩৩নং ওয়ার্ড এবং বনানী থানার ১৯নং ওয়ার্ড।

    এই কমিটি ঘোষণা করার পর থেকেই উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এনে মোহাম্মদপুর থানার ৩৩নং ওয়ার্ডের অন্তত এক ডজন নেতা পদত্যাগ করেছেন।



    অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির ওয়ার্ড কমিটি ঘিরে এলাকাপ্রীতি এবং পদ-বাণিজ্য হয়েছে। যাদের বাড়ি ভোলা তারা কাউন্সিলে পাস করেছেন। আবার যারা অর্থ দিচ্ছেন তারাও কমিটিতে জায়গা পাচ্ছেন।

    এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় বিএনপি নেতারা ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান এবং সদস্য সচিব আমিনুল হকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। পদত্যাগের মহোৎসব থামানোর জন্য আমিনুল হক হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।



    ৩৩নং ওয়ার্ড বিএনপির নবগঠিত কমিটির যারা পদত্যাগ করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন- শামসুর রহমান শাহীন-২নং-সহসভাপতি, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ৩৩নং ওয়ার্ড বিএনপি; মো. জাহাঙ্গীর-সহসভাপতি, সাবেক সহ-হকার্স কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদপুর থানা বিএনপি; মো. কফিল উদ্দিন কফিল- কোষাধ্যক্ষ, সাবেক সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ৩৩নং ওয়ার্ড বিএনপি; মো. সালাউদ্দিন মৃধা-স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক, সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক; মো. কামাল- সহকোষাধ্যক্ষ, সাবেক সহ-প্রচার বিষয়ক সম্পাদক; মো. সোহাগ- সহ দপ্তরবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সদস্য আহ্বায়ক কমিটি; মো. লোকমান- সহ স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সদস্য ৩৩নং ওয়ার্ড বিএনপি; মো. ইউসুফ- সদস্য ও সাবেক সদস্য ৩৩নং ওয়ার্ড বিএনপি, সাবেক সভাপতি ইউনিট বিএনপি; মো. মনির হোসেন পালোয়ান সদস্য ও সাবেক সদস্য ৩৩নং ওয়ার্ড বিএনপি আহ্বায়ক কমিটি।



    বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ১০০নং ওয়ার্ড বিএনপির অন্তত আরও দুই ডজন নেতা পদত্যাগ করবেন।

    অভিযোগ রয়েছে, অর্থ লেনদেনের বিনিময়ে অযোগ্যদের গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার’ বাদলের সহযোগী মোল্লা কাউসারকে সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে।

    বিভিন্ন ইউনিট থেকে অন্তত ১৫ জনকে এনে ওয়ার্ডের সদস্য করা হয়েছে। যদিও ইউনিটের কারো ওয়ার্ডে আসার সুযোগ নেই।

    ৩২নং ওয়ার্ড যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. বিল্লাল হোসেনকে একই ওয়ার্ড বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। মোহাম্মদপুর থানা কৃষকদলের সহ-সভাপতি ফজলুর রহমান ভিকুকে ৩৩নং ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য করা হয়েছে। মোহাম্মদপুর থানা বিএনপির সাবেক সহ-হকার্স কল্যাণ সম্পাদককে ৩৩নং ওয়ার্ড বিএনপির সহ-সভাপতি বানানো হয়েছে। অথচ নিয়ম করা হয়েছে থানা কমিটির কেউ ওয়ার্ড কমিটিতে আসতে পারবে না।



    ৩৩নং ওয়ার্ড বিএনপির কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক পদে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া শাওন আহমেদ স্বপনকে পূর্ণাঙ্গ কমিটির কোথাও রাখা হয়নি। সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বীকারী হাজী মো. মোস্তফাকেও কোনো পদে রাখা হয়নি।

    ৩৩নং ওয়ার্ড বিএনপির সদ্য সাবেক সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক কফিল উদ্দীন কফিলকে অবমূল্যায়ন করে নতুন কমিটিতে ক্যাশিয়ার বানানো হয়েছে। ৩৩নং ওয়ার্ড বিএনপির সদ্য সাবেক ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক কারা নির্যাতিত রজ্জব আলী সুমনকে অবমূল্যায়ন করে নতুন কমিটিতে সহ-সম্পাদক করা হয়েছে। সাবেক সাংগঠনিক জহির হোসেন শাকিলকেও কোনো পদে রাখা হয়নি।

    এছাড়া ৩০নং ওয়ার্ড বিএনপির কমিটিতে কারা নির্যাতিত নেতা সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনোয়ার হাসান জীবনের অনুসারী কাউকে কোনো পদে রাখা হয়নি। এই ওয়ার্ড এর কমিটি গঠিত হয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগ থেকে মনোয়নপ্রাপ্ত কমিশনার আবুল কাশেমের ছোট ভাই বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আমেরিকা ফেরত স্বাধীনের নির্দেশে। অভিযোগ আছে আহ্বায়ক কমিটিতে বিশাল অংকের টাকার বিনিময়ে রাজনীতির মাঠে সম্পূর্ণ নিস্ক্রিয় স্বাধীনকে ১নং যুগ্ম আহবায়ক করা হয়।



    ৩১নং ওয়ার্ড বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. আহসান উল্লাহ শহীদের অনুসারী কাউকে কোনো পদে রাখা হয়নি। ৩৪নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী ফয়সাল ভূইয়া সোহেল, সভাপতি পদপ্রার্থী খাইরুল বাশার মুক্তি ও মহানগর বিএনপির সদস্য হাজী ইউসুফের অনুসারীদের কমিটিতে রাখা হয়নি। ২৯নং ওয়ার্ড এর সাবেক কাউন্সিলর পদপ্রার্থী লিটন মাহমুদ বাবু, সাবেক সাধারণ আব্দুল কাদেরের অনুসারীদের কাউকে কমিটিতে রাখা হয়নি।

    হাউজিং ব্যবসায়ী ও সাবেক সভাপতি এম এস আহমাদ আলী এবং বর্তমান সভাপতি মান্নান হোসেনের নির্দেশে ৩৩নং ওয়ার্ড কমিটি গঠিত হয়েছে। এছাড়া ২৯নং ওয়ার্ড কমিটি গঠিত হয়েছে মোহাম্মদপুর থানা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. এনায়েতুল হাফিজের নির্দেশে। ওয়ার্ডের অন্যান্য সিনিয়র নেতাদের মতামতকে উপেক্ষা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।



    ৩৪নং ওয়ার্ড বিএনপির কমিটি গঠিত হয়েছে ঢাকা-১৩ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি সাদেক খানের ভাতিজা, মোহাম্মদপুর থানা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহবায়ক, বর্তমানে ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি, বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী মাসুম খান রাজেশের নির্দেশে। এই ওয়ার্ডের কমিটি গঠনের বেলায় কাউন্সিলে সর্বোচ্চ দ্বিতীয় ভোট প্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থীদেরও অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।

    ৩১নং ওয়ার্ড কমিটি গঠিত হয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী কারাবন্দি পিচ্চি হেলাল ও তার অনুসারী কমিশনার রাজু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম আসামী সদ্য জেল থেকে মুক্তি প্রাপ্ত পাপ্পুর নির্দেশে। পাপ্পুকে বিভিন্ন সমাবেশে দেখা গিয়েছে ৮০-৯০টি মোটর সাইকেল দিয়ে প্রটোকল দিতে ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুলকে। বিভিন্ন ওয়ার্ডের নেতাদের হুমকি সহ ৩৩নং ওয়ার্ডের এক সম্পাদকের গায়ে হাত তোলার অভিযোগ আছে এই পাপ্পুর বিরুদ্ধে।

    এতসব অভিযোগের বিষয়ে ২৯নং ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের বলেন, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির ওয়ার্ড সম্মেলন ঘিরে এলাকা প্রীতি এবং পদ বাণিজ্য হয়েছে। যাদের বাড়ি ভোলা তাদের চাল চুলা কিছু না থাকলেও তারা কাউন্সিলে পাস করেছেন। কারণ মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হকের বাড়ি ভোলায়। আবার যারা অর্থ দিয়েছেন তারাও কমিটিতে জায়গা পাচ্ছেন।



    পদত্যাগকারী শামসুর রহমান শাহীন বাংলানিউজকে বলেন, ত্যাগী কর্মীদের মূল্যায়ন না করার কারণেই আমরা পদত্যাগ করেছি। আহ্বায়ক এবং সদস্য সচিব হয়তো মনে করেন আমাদেরকে মোহাম্মদপুরে দরকার নেই, এজন্য অবমূল্যায়ন করেছেন। যাদেরকে কমিটিতে রাখা হয়েছে তাদের মধ্যে অধিকাংশ নতুন মুখ। শুনেছি কমিটিকে কেন্দ্র করে অর্থ লেনদেন হয়েছে। অনেকে পয়সার বিনিময়ে পদ পেয়েছেন।

    ১৪ টি মামলার আসামি শামসুর রহমান শাহীন। তাদের গ্রুপ থেকে চারজন এবং আরেকটি গ্রুপ থেকে ৮জনসহ মোট ১২ জন পদত্যাগ করেছেন।



    জানতে চাইলে আরেকজন পদত্যাগকারী মোহাম্মদ কফিল উদ্দিন কফিল বলেন, রাজপথের ত্যাগী পরীক্ষিত নেতাদেরকে বাদ দিয়ে নতুন লোক দিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। অন্যান্য ইউনিট থেকে লোক এনে এখানে পদায়ন করা হয়েছে। দলের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার জন্য বিভিন্ন চাপের কারণে দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাড়ির বাইরে থাকতে হয়েছে। এমনকি ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ করার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাড়ির বাইরে রয়েছে। পূর্বের কমিটিতে যে পদে ছিলাম সেখান থেকে ডিমোশন কিভাবে দিচ্ছে! আপনি কমিটিতে রাখতে না পারলে বাদ দিয়ে দেবেন, কিন্তু অবমূল্যায়নতো করতে পারেন না। যাদের টাকা-পয়সা রয়েছে তারা ভালো পদ পেয়েছেন। আমার টাকা থাকলে হয়তো আমিও ভালো পদে যেতে পারতাম। যাদের কখনো আন্দোলন, সংগ্রাম ও রাজপথে দেখিনি তাদেরকে এনে কমিটিতে বসানো হয়েছে। ত্যাগী নেতাদের অবমূল্যায়ণ করার কারণে আমিসহ আরো অনেকেই গণপদত্যাগ করেছি।



    ঢাকা উত্তর বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বে থাকা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। লোক মারফতে শুনতে পেরেছি। অনেকে হয়তো তাদের কাঙ্ক্ষিত পদ-পদবী না পাওয়ার কারণে অসন্তুষ্ট হয়ে পদত্যাগ করতে পারেন।

    জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক বাংলানিউজকে বলেন, কারা পদত্যাগ করেছে কিংবা কেন করেছে এমন কোনো তথ্য এখনো আমাদের কাছে আসেনি। কোনো অভিযোগ পাইনি। এরপরও যদি কেউ পদত্যাগ করে থাকে, আমাদের লিখিতভাবে জানায় তাহলে আমরা কারণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে দেখব।



    কমিটিতে প্রভাব ও অর্থ লেনদেনে জড়িত থাকা কিংবা তার ওপর অসন্তষের বিষয়ে জানতে চাইলে আমিনুল হক বলেন, অভিযোগ রাজনীতির বড় একটি অংশ। আমার বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ করেছে এটা সত্য নয়। যে বা যারা করেছে এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা বানোয়াট।

    এর আগে গত ২ জুলাই ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির মোহাম্মদপুর থানার ৫ টি ওয়ার্ড ২৯, ৩১, ৩২,৩৩ ও ৩৪ কমিটির সন্মেলনে অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে কমিটি গঠনে পদ বাণিজ্য এবং আঞ্চলিক সম্পর্ককে প্রাধান্য দেয়ার অভিযোগ উঠে। এসময় বিক্ষুব্ধ একটা গ্রুপ প্রতিপক্ষের উপর হামলা চালিয়ে মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান এবং সদস্য সচিব আমিনুল হককে লাঞ্ছিত করে। এ ঘটনায় উভয় পক্ষের কয়েকজন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।



    আরও খবর 17

    Sponsered content